‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও বেকারত্বে বাড়ছে হাহাকার’ : লেখক -হাসিব আহমেদ
সুজলা-সুফলা শস্যশ্যামলায় ভরপুর বাংলাদেশ আজ শ্রীহীন হয়ে পড়ছে। অভাব ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে আজকের জনজীবন দুঃখ ও হাহাকারে পূর্ণ। মানুষের ওপর চেপে বসেছে দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব। জীবন ধারণের উপযোগী প্রতিটি জিনিসের অগ্নিমূল্য! ফলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের নাভিঃশ্বাস উঠেছে।
করোনা অতিমারির প্রথম ঢেউয়ের আর্থ-সামাজিক সঙ্কট কাটতে না কাটতেই দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে। সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়েই চলছে। বেকারত্বের হার ঊর্ধ্বমূখী। নিম্ন আয়ের পরিবারের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ ঘোষণার পর দেশজুড়ে পাটকল শ্রমিকরা কর্মহীন দিন কাটাচ্ছে। তার সাথে নতুন সংযোজন দেশের ১৫ টি চিনিকলের মধ্যে ৬ টি করে আখ মাড়াই বন্ধ ঘোষণা করায় কয়েক হাজার চিনিকল শ্রমিকও কর্মচ্যূত হচ্ছেন। দেশে উৎপাদিত লাল চিনির ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সরকার লোকসানের খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে শ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে কলগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। রংপুরে গত সপ্তাহে চিনির দাম বেড়ছে কেজিতে ১০ টাকা।
ঢাকার এ ওয়ান বিডি গার্মেন্টের শ্রমিকেরা ৮০ দিন ধরে ১১ মাসের ন্যায্য বকেয়া পাওনার জন্য অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে। করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় রপ্তানিমুখি তৈরি পোশাক খাতে সরকার দেশি-বিদেশি ক্রেতা ও দাতা গোষ্ঠীর কাছ থেকে ৬২ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকার ঋণ প্রণোদনা ও আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। যার মধ্যে ৮৩.৯৭ শতাংশই কারখানা মালিকদের ব্যবসায়িক সঙ্কট মোকাবেলায় ব্যবহার করা হয়েছে। আর বেতন-ভাতা বাবদ শ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ ছিলো মাত্র ১৬.৩ শতাংশ।
উল্লেখ্য, প্রণোদনায় রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও তদবিরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। মালিক পক্ষ ব্যবসায় সম্ভাব্য ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা আদায় করে নিতে সক্ষম হলেও শ্রমিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তায় কোনো পরিকল্পনা ও কার্যকর কৌশল প্রণয়ন করে নি। বরং করোনা সঙ্কটে প্রাথমিক পর্যায়ে মালিকরা শ্রমিকের স্বার্থ বিবেচনায় না নিয়ে শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থে কারখানা লে অফ করেছে৷
সম্প্রতি ILO প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ন্যূনতম মজুরি দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবার পেছনে। শুধু তাই নয় এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের ন্যূনতম মজুরি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দারিদ্র্যসীমার নিচে (৪ হাজার ৮০ টাকা)।
এতো কম মজুরিতে কোনো রকম খেয়ে-পরে দিন যাপন করার মতো সুযোগও কেড়ে নিয়েছে করোনা মহামারীর অভিঘাত। বেকারত্বে ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষ।
কারণে অকারণে বাড়ছে চালের দাম। আমন মৌসুমে চলছে ধানের বাম্পার ফলন। তবে ক্রেতাদের মুখে হাসি নেই। কেজি প্রতি ৫০ টাকার নিচে মিলছে না কোনো চাল। একটু ভালো চালের দাম ৬০ টাকা বা তার চেয়ে বেশি। যদিও আমন ধানের চাল বাজারে এসেছে এবং সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই কিন্তু এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব বাজারে নেই। দাম নিয়ে অস্বস্তি বাড়ছে ক্রেতাদের। এক কেজি খুদের দাম ৪০ টাকা ভালো মানের খুদ ৪৫ টাকা।
খাদ্য মন্ত্রনালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, “আমাদের হিসেব অনুযায়ী গত বছরে যে চাল উৎপাদিত হয়েছে তা থেকে ৩০ লক্ষ টন উদ্বৃত্ত আছে।”
অন্যদিকে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, “বর্তমানে ৬০ লক্ষ টন চাল বাড়তি আছে এবং এ মৌসুমে ১২ লক্ষ টন চাল বেশি পাওয়া যাবে।” উৎপাদন এতো বাড়ন্ত থাকা সত্ত্বেও বৈশাখের আগে চালের দাম বাড়ার আশঙ্কা করছে বিক্রেতারা। রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন হলেও কোনোভাবে মূল্য বৃদ্ধির লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না।
সরকার চালের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য কৃষকদের থেকে ধান কেনার যে দাম নির্ধারণ করেছে তাতে খুশি নয় কৃষকরা। তারা বলেন, এভাবে চললে আবাদ সম্ভব হবে না।
সরকার খাদ্য গুদামের মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও নভেম্বর পর্যন্ত তারা কোনো কার্যক্রম শুরু করে নি। নভেম্বরে খাদ্য গুদামে কৃষকরা ২৬ টাকা দরে ধান দিতে রাজি হয় নি কারণ মিলাররা ( মিল মালিকরা) এর চেয়ে বেশি দর হেঁকেছে। তুলনামূলক বেশি দরে কৃষকদের কাছ থেকে মিলাররা ধান কিনে নিয়ে মজুত করে রেখেছে। আমন ওঠার সাথে সাথে ব্যবসায়ি ও মিলাররা ধান স্টক করেছে।
দেশের উৎপাদন ও পণ্যের দামের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত এক দশকে চালের উৎপাদন বেড়েছে ৫০ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। তারপরও দাম বেড়েছে প্রায় দেড় গুণ। ভোক্তাপর্যায়ে চালের মূল্যবৃদ্ধি বিষয়ে মধ্যসত্ত্বভোগীদের দায়ী করেছে সংশ্লিষ্টরা। সরকারের নিম্নমহল এ বিষয়টি স্বীকার করেছেন অনেকবার। তারপরও নানান অদৃশ্য কারণে চালের দাম কমাতে সরকারের নেয়া কোনো পদক্ষেপে সুফল মেলে নি।
কয়েক বছর আগে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে আলু খাওয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করে বেশি বেশি আলু খান ভাতের ওপর চাপ কমান স্লোগান তোলা হলেও সেই আলু এখন নিম্নবিত্ত পরিবারের নাগালের বাইরে৷। গত ১৮ ডিসেম্বর নতুন আলু ৪০-৫০ এবং পুরান আলু ৩২- ৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ১৭ ডিসেম্বর কারওয়ান বাজারে আলু বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকায়।
দেশে সয়াবিন তেলের দাম গত ৪ মাসে লিটার প্রতি ১৩ থেকে ২২ টাকা বাড়ার পরও কোম্পানিগুলো বলছে দাম আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ গত আগষ্ট মাসে ৫ লিটার তেল কেনা যেত ৫০৫ থেকে ৫১৫ টাকায়। এখন বাজারে ৫৭০ থেকে ৬২৫ টাকা। পাম তেলের দাম এক বছরে ৩১% বেড়েছে। ভোজ্য তেলের মতো একটি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে তিন স্তরে ১৫ শতাংশ ভ্যাট কার্যকর রয়েছে।
সপ্তাহের ব্যবধানে (১৯ ডিসেম্বর) দেশি পেঁয়াজের দাম ৪.৫৫ শতাংশ বেড়ে দাম ৬৫ টাকা হয়েছে৷
আটা, তেলসহ নানান পণ্যের দাম বৃদ্ধির জন্য চাঁদপুরে ১২ বছরের ইতিহাস ভেঙে বেকারি পণ্যের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে।
আমদানিকৃত সয়াবিন তেলে আগে ১ স্তরের ভ্যাট দিতে হতো। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করা হয়। এরপর থেকে তিন স্তরে ভ্যাট আরোপ হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়া কমার সঙ্গে অভ্যন্তরীন দাম ওঠানামা করে। বিষয়টি সুরাহায় ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে
কয়েক দফা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। এরপর ৮ মাস কেটে গেলেও অর্থ মন্ত্রণালয় কোন ব্যবস্থা নেয় নি।
দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে দাম ঊর্ধ্বমুখী হলেও কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও টিসিবির ওয়েবসাইটে পণ্যমূল্যের যে তালিকা পাওয়া যায় তার সাথে সরেজমিনের চিত্র একেবারে বিপরীত। তাছাড়াও বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণ প্রশাসক কে তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে রয়েছে খোদ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। কৃষি পণ্যের ক্ষেত্রে কৃষক পর্যায়ে দাম নির্ধারণ করে দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। খুচরা পর্যায়ে যৌক্তিক দাম নির্ধারণ ও অভিযানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরকে। আবার নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব খাদ্য মন্ত্রণালয়ের।
সরকারের পণ্য দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বরত মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সমন্বয়হীনতার কারণে বাজার সঠিক মনিটরিং হচ্ছে না। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে জনসাধারণকে। বাজারের সিন্ডিকেটগুলো পরিচালনা হচ্ছে কার্যত ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা সাঙ্গ-পাঙ্গ দ্বারা। তারা ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় এতটাই অনমনীয় হয়ে উঠেছে যে আমনের ভরা মৌসুমে সরকার ঊর্ধ্বমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে ভারত থেকে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকার নিজেই বলেন তারা নাকি সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি!
একদিকে, সরকার ভ্যাট ট্যাক্সের নামে সর্বসাধারণের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মেগা প্রজেক্টেগুলোতে ব্যস্ত রয়েছে। অন্যদিকে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো করোনায় কর্ম হারিয়ে ঊর্ধ্বমূখী দামের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে। ধনী-দরিদ্র বৈষম্য বাড়ছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত হিসাবে জানা গেল, মার্চ থেকে জুন এই তিন মাসে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ৪১২। জিডিপির পরিমাণ বেড়েছে, রেকর্ড পরিমাণ রিজার্ভ জমা হচ্ছে, পদ্মাসেতু দৃশ্যমান অগ্রগতি হচ্ছে। অপরদিকে সংবিধানে মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রধানতম বিষয় খাদ্য সংস্থানের বিষয়টি ক্রমেই সংকুচিত হয়েছে।
স্বাধীন দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বল্গাছাড়া অবস্থা দরিদ্র ব্যক্তিদের পক্ষে বজ্রাঘাততুল্য। আগামী বছরে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হবে৷ দীর্ঘ ৫০ বছরেও শাসকগোষ্ঠী শ্রমিকদের জন্য বাঁচার মতো মজুরি নিশ্চিত করতে সক্ষম হয় নি। যাদের শ্রমে-ঘামে দেশের অর্থনীতি সচল তারাই সবচেয়ে অভাব-অনটনে জর্জরিত, শোষিত-বঞ্চিত। আগামী দিনে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর বাঁচার ন্যূনতম অধিকার তথা সকল ব্যক্তি কর্মসংস্থানে নিয়োজিত থেকে সহনীয় বাজার মূল্যে নির্বিঘ্নে দিনাতিপাত করতে পারবে কি?
লেখক : হাসিব আহমেদ, সংগঠক, মওলানা ভাসানী পাঠাগার, বরিশাল।
তথ্যসূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক দেশ রুপান্তর, জাগো নিউজ বিডি।
বিডিনিউজ ইউরোপ /২৩ ডিসেম্বর / জই