খুবি উপাচার্যকে খোলা চিঠি দিলেন রাবি অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম কনক
আজ বুধবার ( ২০ জানুয়ারি) দুপুরে “প্রয়োজনে স্বৈরাচার আমলে গৃহীত নীতিমালা পরিবর্তন করুন: শিক্ষক-শিক্ষার্থী অপসারণ বা বহিষ্কার নয়” শিরোনামে ফেইসবুকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ ফায়েক উজ্জামানকে উদ্দেশ্য করে একটি খোলা চিঠি লিখেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম কনক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সহযোগী অধ্যাপক খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অপসারণ ও বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই এই খোলা চিঠি লিখেন। অধ্যাপক তাঁর খোলা চিঠিতে যা লিখেছেন তা হুবহু তুলে ধরা হলো-
“১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন শিক্ষার্থী এবং তিনজন শিক্ষককে সম্প্রতি বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার ও অপসারণের সিদ্ধান্তের বিষয়টি কয়েক দিন যাবত সোশ্যাল মিডিয়া, বিভিন্ন ধরনের অনলাইনভিত্তিক পোর্টাল ও প্রথম আলোসহ বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার মাধ্যমে দেশবাসী অবহিত। প্রয়াত স্বৈরাচার ও সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের শাসনকালে প্রতিষ্ঠিত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে শিক্ষক বা শিক্ষার্থীরা কোনো ন্যায়সঙ্গত দাবি করতে পারবে না? সাজাপ্রাপ্ত এবং অনশনরত শিক্ষার্থীদের যে পাঁচটি দাবি তা খুবই যৌক্তিক। ন্যায়সঙ্গত দাবি করার অধিকার শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারী-কর্মকর্তা সকলেরই আছে। যদি এমন দাবি স্বৈরাচার আমলে গৃহীত বিশ্ববিদ্যালয় নীতিমালার পরিপন্থী হয়, প্রয়োজনে তা পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হয়রানি, অপসারণ কিংবা বহিষ্কারাদেশ জাতির জন্য অশনিসংকেত। ব্যক্তিগত কলরেকর্ড, ফেসবুক, মেসেঞ্জারে নজরদারি এবং আঁড়িপাতার মতো ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের বিষয়টি যদি সত্য হয়ে থাকে, তবে তা আরও হতাশাজনক।”
“জ্ঞানতাত্ত্বিক অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় সার্বিক জ্ঞানপ্রচার ও চর্চাকেন্দ্র এবং আইনি অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় সার্বিক জ্ঞান উৎপাদন করবে; তা রাষ্ট্র, ধর্ম এবং সমাজ-রীতির বিপরীতে গেলেও প্রকাশযোগ্য। যখন কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহীর ওপর অর্পিত ক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর বিপক্ষে যায়, তখন সে প্রশাসনকে গণতান্ত্রিক বলা যায় না। কেবল অনুগত ও সনদধারী দাস তৈরি করাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নয়। অধিকার প্রতিষ্ঠা, সাংস্কৃতিক চর্চার পথ ধরে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা, অসাম্প্রদায়িকতা, দেশপ্রেম এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার দায়িত্বও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বর্তায়। বিশেষ ক্ষমতাধর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী তথা উপাচার্যের এককেন্দ্রিক ক্ষমতা চর্চা, স্বেচ্ছাচারী আচরণ, সকল ক্ষেত্রেই কর্তৃত্ব প্রদর্শন ও দমনমূলক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন উচ্চশিক্ষার ধারণার সাথে যায় না। স্বায়ত্তশাসন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং শিক্ষকদের জন্য যে মর্যাদা দেয়, প্রশাসনিক নির্বাহীর ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে তা পদে পদে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক সরকারের মনোনীত কিংবা বিশেষ রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচাযের্র দায়িত্বগ্রহণ করলেই কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে আইন, প্রাপ্ত ক্ষমতার অপব্যবহার, সিনেট-সিন্ডিকেটের যথেচ্ছা প্রয়োগ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অধিকার ও বাক-ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর কোনোরূপ উদ্দেশ্যমূলক হস্তক্ষেপ মোটেই কাম্য নয়।”
“খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানানোয় বাংলা ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক আবুল ফজল, একই ডিসিপ্লিনের প্রভাষক শাকিলা আলম এবং ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিনের শিক্ষক হৈমন্তী শুক্লা কাবেরীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গত ১৮ জানুয়ারি সোমবারের সিন্ডিকেট কমিটির বৈঠকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই ঘটনায় বাংলা ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী মোবারক হোসেন নোমান এবং ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা ডিসিপ্লিনের ইমামুল ইসলাম সোহানকে যথাক্রমে দুই ও এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ বেশ কিছু পত্রিকা, সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইনভিত্তিক পোর্টালের সূত্র থেকে জানা যায় ২০২০ সালের ১ জানুয়ারিতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেতন কমানো, আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অবকাঠামো নির্মাণ ও ছাত্র সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল। এর প্রায় ৯ মাস পরে ওই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানানোয় চারজন শিক্ষককে গত বছরের ১৩ অক্টোবর কারণ দর্শানো নোটিশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তিন দিনের মধ্যে নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়। ওই চিঠির জবাব দেওয়া হলে গত ৯ নভেম্বর আরেকটি কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। ২৩ নভেম্বরের ওই চিঠি জবাব দেওয়া হলে ২৪ নভেম্বর ‘তদন্ত কমিটি’ গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ৭ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আবারও চিঠি দিয়ে ১০ ডিসেম্বর হাজির হয়ে প্রতিবেদন প্রদানের কাজে সহযোগিতা করার জন্য ওই তিন শিক্ষককে ডাকা হয়। পরে ১৩ ডিসেম্বর বিশেষ সিন্ডিকেট ডেকে আবারও তিনজনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। ১০ জানুয়ারি ওই চিঠির জবাব দেন শিক্ষকেরা। এরপর গতকাল ১৮ জানুয়ারি চূড়ান্ত কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় প্রশাসন। নোটিশে বলা হয়, গত ১৮ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট মিটিংয়ে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন মোতাবেক তাদের অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নোটিশে বলা হয়, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কেন অপসারণ করা হবে না, আগামী ২১ জানুয়ারির মধ্যে তা জানাতে হবে। একজন শিক্ষককে বার বার নোটিশ প্রদান করার কারণে তার পাঠাভ্যাস, লেখালেখি, গবেষণা, পাঠদান ও মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ডেইলি স্টার পত্রিকার অনলাইন সংস্করণের সূত্রে একজন শিক্ষকের কথা জানা যায়, ১৮ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১২টায় তাকে ই-মেইলে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। পরের দিন বেলা ১১ টার দিকে তার বাসায় চিঠি এসেছে। সেখানে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অপসারণের কথা জানানো হয়েছে এবং ২১ জানুয়ারির মধ্যে নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, নোটিশের জবাব দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত শিক্ষকদের কমপক্ষে ১০ দিন সময় দেওয়া উচিত ছিল বলে তারা মনে করেন। কিন্তু তা করা হয়নি। বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সামনে অনশন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। আন্দোলনরত একজন শিক্ষার্থীর বক্তব্য, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন স্বেচ্ছাচারিতা করছে। যতক্ষণ প্রশাসন তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসছে, আমাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না করছে করছে, ততক্ষণ আমরা অনশন চালিয়ে যাব।’ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অপসারণ ও বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।”
বিডিনিউজ ইউরোপ /২০ জানুয়ারি / জই