সৈকতের ভাঙন রোধে ফিরিয়ে আনা হবে ‘ডেইল’!
মাত্র ২ যুগ আগেও কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্রের তীর ধরে দেখা যেত ২০ থেকে ৩০ ফুট উঁচু পাহাড়ের মতোই বড় বড় বালির ঢিবি বা ‘ডেইল’। এই ডেইলগুলো সৈকতের প্রাকৃতিক রক্ষা কবচের মতো সাইক্লোনের বড় বড় ঢেউ ও জলোচ্ছ্বাস ঠেকিয়ে দিতো। ফলে কক্সবাজার উপকূল রেখায় ডেইল কেন্দ্রিক বহু সভ্যতা গড়ে ওঠে। কিন্তু সেই ডেইলগুলো ধ্বংস করে সেখানে অপরিকল্পিতভাবে সরকারি–বেসরকারি নানা স্থাপনা গড়ে ওঠায় সাম্প্রতিককালে ভাঙনের মুখে পড়েছে সৈকত, এগিয়ে আসছে সমুদ্র। ভাঙন ঠেকাতে কংক্রিটের ব্লক, জিও ব্যাগের ব্যবহার খুব একটা কাজে আসছে না। এই অবস্থায়কক্সবাজার সৈকতে পরিবেশগত পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া সেই ডেইলগুলো পুনরায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের অর্থায়নে ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ‘একলাব’ ও ‘সাগরসেবা’ নামের দুটি বেসরকারি সংস্থা উপকূল সুরক্ষা কর্মসূচির অধীনে এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রাথমিকভাবে এক বছর মেয়াদী একটি প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগরতীরের ৬টি স্পটে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উপায়ে ডেইল তৈরি করা হবে বলে জানান প্রকল্প কর্মকর্তা উম্মে মারজান জুঁই। তিনি জানান, কক্সবাজার–টেকনাফ সৈকতে ডেইল তৈরির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশিয়ানিক অ্যান্ড অ্যাটমস্ফরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (নোয়া) বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হবে। এক বছর মেয়াদী প্রকল্পটি সফল হলে পরবর্তীতে ৫–১০ বছর মেয়াদী প্রকল্পে অর্থায়ন করবে বৈদেশিক সংস্থাটি।
বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ডেইল বা বালির পাহাড়টি আর্জেন্টিনায় অবস্থিত। ‘ডোনা ফেডরিকো কিরবোস’ নামের এই ডেইলটির উচ্চতা ৪০৩৫ ফুট বা ১২৩০ মিটার। আর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৯৩৩৪ ফুট বা ২৮৪৫ মিটার। এটি দক্ষিণ আফ্রিকার টেবিল পাহাড় ও যুক্তরাজ্যের স্নোডাউন পাহাড়ের চেয়ে উঁচু। এছাড়া ওমানের ‘এমটি কোয়াটার’ নামের ডেইলটির উচ্চতা ১৪৯২ ফুট, চীনের ‘বাদাইন জারান’ ডেইল এর উচ্চতা ১৩০০ ফুট, নমিবিয়ার ‘ডোন–৭’ এর উচ্চতা ১২৫৬ ফুট, আর ইউরোপের সর্বোচ্চ ডেইল ফ্রান্সের ‘ডোন দো পিলাত’ এর উচ্চতা ৩৫০ ফুট।
বাংলাদেশের কোন উপকূলে এত উঁচু ডেইল না থাকলেও একসময় কক্স বাজার উপকূলের কুতুবদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত বিভিন্ন সৈকতে ৩০–৩৫ ফুট উচ্চতার ডেইল দেখা যেত। আর সমুদ্র তীরের বাসিন্দারা এই ধরনের ডেইল ঘিরেই লোকালয় তৈরি করে। যে লোকালয়গুলো ডেইলপাড়া নামে পরিচিতি পায়। যেমন কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল, কক্সবাজার শহরের ফদনার ডেইল, উখিয়া জালিয়াপালং এর ডেইল পাড়া ও ইমামের ডেইল, টেকনাফের মুন্ডার ডেইল ও সেন্টমার্টিনের ডেইলপাড়া অন্যতম। কক্সবাজার জেলায় এই ধরনের ডেইলকেন্দ্রিক আরো বহু লোকালয় রয়েছে। আর ডেইলগুলোর নিচে রয়েছে মিষ্টি পানির জলাধার। কিন্তু এসব ডেইল ঘিরে ধীরে ধীরে সরকারি বেসরকারি আরও নানা স্থাপনা গড়ে ওঠার ফলে এখন আর শহরের কোথাও উঁচু ডেইল দেখা যায় না। তবে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র তীরের সেই পাহাড়সম ডেইলগুলো হারিয়ে গেলেও কক্স বাজার শহরের পাশের দ্বীপ সোনাদিয়ায় এখনও টিকে রয়েছে ২০–২৫ ফুট উচ্চতার কয়েকটি ডেইল। আর ডেইলগুলো উপকূলে প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করছে বলে জানান বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর। তিনি জানান, যেখানে দেশি জাতের নিশিন্দা ও কেয়া জাতীয় উদ্ভিদ রয়েছে, সেখানেই টিকে রয়েছে ডেইলগুলো। আর যেখানে কোন স্থাপনা অথবা ঝাউগাছ রয়েছে, সেখানে ডেইলগুলো ক্ষয়ের মুখে পড়েছে।
সাম্প্রতিককালে কঙবাজার জেলার উপকূলীয় অঞ্চলে ভাঙন বৃদ্ধির পেছনের কারণ হিসেবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সৈকত ও ডেইল রক্ষায় পদক্ষেপহীনতা, ক্ষতিকর আগ্রাসী ও আগন্তুক জাতের গাছের বাগান করা (যেমন অস্ট্রেলিয়ান পাইন বা ঝাউগাছ), ডেইল ভাঙলে সেই ডেইলের প্রতিবেশগত পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো জিও–টিউব বসানো এবং উপকূলের হার্ডেনিং বা পাকাকরণ ব্যবস্থাকে দায়ী করেন সোসাইটি ফর কনজার্ভেশন বায়োলজি’স মেরিন সেকশন এন্ড সোশ্যাল সায়েন্স ওয়ার্কিং গ্রুপ এর বোর্ড মেম্বার ও একলাবের কোস্টাল প্রটেকশন প্রোগ্রামের এডভাইজর কুতুব উদ্দিন আরজু।
তিনি বলেন, সৈকত ও ডেইলের উপর বা খুব কাছে নানা পাকা অবকাঠামো যেমন পাকা রাস্তা, কংক্রিটের ব্লক, দেয়াল, বাঁধ, টেট্রাপড বানালে স্থানীয় জাতের উদ্ভিদ ও প্রাণীদের আবাসস্থল নষ্ট হয় এবং সৈকতে বালু জমা হওয়া ও ডেইল তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাগর–ঘেঁষে এইসব পাকা অবকাঠামো বানানো ও বিদেশি ক্ষতিকর গাছের বাগান করাসহ এইসব কার্যক্রমের পরিণতিতে এই উপকূলের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ ডেইল এখন নানা জায়গায় হয় ধ্বংস হয়ে গেছে, নয়তো ধ্বংস হবার পথে। এই অবস্থায় উপকূলের জলবায়ু পরিবর্তন–সহিষ্ণু অবকাঠামো নিশ্চিত করা, ভাঙন ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ–প্রাণবৈচিত্র্যের সুরক্ষার কার্যকরী পদ্ধতি হচ্ছে লিভিং শোরলাইনস বা জীবন্ত উপকূল।
নোয়ার দেয়া গবেষণা তথ্যে দেখা যায়, জীবন্ত উপকূল কার্বন জমায়, ভাঙন কমায়, জলোচ্ছ্বাস ঠেকায়, প্রাণবৈচিত্র্যের আবাসভূমি হয় এবং সার্বিকভাবে মানুষ ও পরিবেশের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করে। আর পাকাকরণের শিকার উপকূলের চেয়ে জীবন্ত ও প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত উপকূল ঝড়–জলোচ্ছ্বাস ও ভাঙন মোকাবিলায় ভালো ভূমিকা রাখতে সক্ষম। কুতুব উদ্দিন আরজু বলেন, জীবন্ত উপকূল পদ্ধতির আলোকে কঙবাজার উপকূলে ডেইল ও সৈকতের প্রতিবেশগত পুনরুদ্ধার, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা খুব কম খরচে করা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে স্থানীয় জাতের উদ্ভিদ, পাথর, ও বালু এবং অন্যান্য জৈব সামগ্রীকে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করে সৈকত সুরক্ষিত করা হয়। সাগরপাড়ে কংক্রিটের দেয়াল বা অন্যান্য পাকা বাঁধ বা অবকাঠামো বসালে তাতে যেভাবে উদ্ভিদ বা প্রাণীদের বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয় জীবন্ত উপকূল পদ্ধতিতে সেই ঝুঁকি থাকে না।
ডেইল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণায় বলা হয়, সাগরের স্রোতে বালু আসে। সেই বালু ঢেউয়ে ভর করে ও বাতাসে ভেসে উপকূলে জমা হয়ে সৈকত চওড়া ও উঁচু করে। পুরনো সৈকতে এবং সৈকত ও উপকূলীয় জমির মাঝখানে তৈরি হয় উঁচু ডেইল। আবার বাতাসের তোড়ে এই ডেইল থেকে বালু ছড়ায় সৈকতজুড়ে। আর ঝড়ো আবহাওয়ার সময় উঁচু ও শক্তিশালী ঢেউয়ের শক্তি সামাল দেয় এই বালির ঢিবি। সামুদ্রিক ঢেউগুলো তখন ডেইলে আছড়ে পড়ে এবং ডেইলের বালু টেনে সাগরের দিকে নিয়ে যায়, আর জমা করে উপকূলীয় অগভীর সাগরতলে। এতে সৈকত প্রায় সমতল হয়ে যায় এবং ওই এলাকায় সমুদ্রতলের উচ্চতা বাড়ে। সৈকত থেকে দূরে বালুর ওই ডুবোচরে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ঢেউয়ের শক্তি কমে যায়।
গবেষণায় আরও বলা হয়, বর্ষাকাল যখন চলে যায়, তখন ছোট ছোট ঢেউ পুনরায় সেই বালুগুলো সৈকতের দিকে নিয়ে আসতে থাকে। বাতাসে ভেসে সেই বালু ডেইলের দিকে আসে এবং জমা হয়। আবার শুরু হয় ডেইল উঁচু হবার প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। কিন্তু সেই বালু আটকে উঁচু উঁচু ডেইলে পরিণত হবে তখনই, যখন সৈকত ও ডেইলে অন্য কোনো পাকা বা আধাপাকা প্রতিবন্ধক থাকবে না, কেউ ডেইল মাড়াবে না এবং ডেইল ও উপকূলীয় জমিতে স্থানীয় জাতের লতাপাতা–ঝোঁপঝাঁড়–গাছগাছালি থাকবে।
প্রকল্প কর্মকর্তা উম্মে মারজান জুঁই বলেন, কক্সবাজার উপকূলে সক্রিয় স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ডেইল গুরুত্বপূর্ণ। এই ডেইল ভরা জোয়ার, বিশাল ও শক্তিশালী ঢেউ, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক সুরক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। আর এই ডেইলগুলোতে বিচিত্র রকমের প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল এবং বালুর প্রাকৃতিক গুদামঘর; ভেঙে যাওয়া বা অন্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সৈকতে বালুর যোগান দিয়ে সুস্থ করে। এই উপকূলে ধ্বংসপ্রাপ্ত পুরনো ডেইলগুলোর প্রতিবেশগত পুনরুদ্ধার এবং নতুন ও মৌসুমী ডেইল তৈরি হওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা দূর করা একটি জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর এক্ষেত্রে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগত জ্ঞানের উপরও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর আগে সোনাদিয়া দ্বীপে ও কক্সবাজার শহরতলীর দরিয়ানগর সৈকতে সাগরলতা–নিশিন্দার বনায়নের মাধ্যমে কৃত্রিম উপায়ে ডেইল তৈরিতে সফল হন স্থানীয় গবেষকরা।
লেখক:বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক, কলামিস্ট এবং গবেষক আহমেদ গিয়াস
কক্সবাজার
বিডিনিউজ ইউরোপ২৪ডটকম/৮জানুয়ারি/জই