ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ(Vaccine nationalism):
করোণা মহামারীর ভ্যাকসিন অাবিষ্কার ও উৎপাদনের জন্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাতদিন কাজ চলছে।অনেকে হয়ত আশা করছেন,ভ্যাকসিন পাওয়া গেলে করোণা নির্মুল হবে।জেনে রাখা ভালো,সংক্রামক ব্যাধির মধ্যে এ যাবত কেবল Small pox বা গুটিবসন্ত ভ্যাকসিন দিয়ে নির্মুল করা সম্ভবপর হয়েছে এবং এতে সময় লেগেছে প্রায় ২০০ বছর।যক্ষা,পোলিও,হাম,মাম্পস্ ইত্যাদির ভ্যাকসিনের ব্যাবহার চললেও রোগগুলো অদ্যাবধি নির্মুল হয়নি।ভ্যাকসিন ব্যবহারের মাধ্যমে সংক্রমন নিয়ন্ত্রন,কমানো বা রোধ করা যায়,রোগ নির্মুল করার সম্ভাবনা নেই বলা যায়।
২। নতুন ভ্যাকসিনের ব্যাবহারোপযোগীতা প্রমাণের জন্যে তিন স্তরের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল আবশ্যক।১ম স্তরে কয়েকজন,২য় স্তরে কয়েকশ এবং ৩য় স্তরে হাজার হাজার মানুষের শরীরে ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে হয়।চুড়ান্ত পর্যায়ে নিরাপদ এবং কার্যকর প্রমাণিত হলে যথাযথ কতৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে উৎ পাদন এবং সরবরাহের ব্যাবস্থা নেয়া যায়।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্হা(WHO) বলছে,বর্তমানে প্রায় ১৫০ ভ্যাকসিন উন্নয়নের কাজ চলছে এবং তন্মধ্যে ৪৪ টি বিভিন্ন পর্যায়ের ট্রায়ালে রয়েছে।১১ টির ট্রায়াল চুড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।জানা যাচ্ছে,ফাইজার এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকসিন দুটির FDA অনুমোদনের জন্যে নভেম্বর ২০২০ মাসেই অাবেদন করা হবে।ডিসেম্বর মাস থেকেই আমেরিকা এ ভ্যাকসিন ব্যাবহারের পরিকল্পনা করেছে।ফাইজার দাবি করেছে তারা ৩য় পর্যায়ে ৪৩৫০০ জনের শরীরে তাদের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে ৯০% এর ক্ষেত্রে সফলতা পেয়েছে। কিন্তু ৯০% এর মধ্যে কতজন প্রাকৃতিকভাবে Immune (যারা ভ্যাকসিন ছাড়াই রোগাক্রান্ত হতনা) সে তথ্য নেই।তাছাড়া,ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কতদিন থাকবে তাও পরীক্ষিত নয়।এদিকে রাশিয়া ১৬০০০ জনের উপর চুড়ান্ত পরীক্ষা করে তাদের ভ্যাকসিন “স্পুটনিক-৫ ” ৯২% লোকের ক্ষেত্রে কার্যকর পেয়েছে বলে দাবী করেছে।ফরাসী কোম্পানি সনোফি,মার্কিন কোম্পানি মডার্না এবং জনসন এন্ড জনসন এর ভ্যাকসিনের ট্রায়াল ও চুড়ান্ত পর্যায়ে বলে জানা গেছে।চীন সম্পর্কে তথ্যের অভাব রয়েছে।জানা গেছে, তাদের চারটি ভ্যাকসিন এর কাজ শেষ পর্যায়ে।তবে ইতোমধ্যে চীন দুটি ভ্যাকসিনের ব্যবহার শুরু করেছে বলে জানা গেছে।একটি সেনাবাহিনীকে এবং অন্যটি শ্রমিকদের দেয়া হচ্ছে।
৩।ভ্যাকসিন নিয়ে অামেরিকা,ইংল্যান্ড,জার্মানী,ফ্রান্স ইত্যাদি ধনীদেশগুলো অগ্রহণযোগ্য একপেশে কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে।এতে ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ বা Vaccine Nationalism এর শিকারে পরিণত হচ্ছে নিম্ন অায়ের সব দেশ।ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের মূল কথা হল”My country first” অর্থাৎ আমার দেশ আগে।প্রথম দিকে উৎপাদিত ভ্যাকসিন ধনী দেশগুলো অাগে নিবে এবং নিম্ন অায়ের দেশগুলো পাবে পরে।এলক্ষ্যে ধনী দেশগুলো বেশ অাগেই ভ্যাকসিন কোম্পানিগুলোর সাথে Pre-purchase Agreement করে রেখেছে।অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের প্রথম ৩০ মিলিয়ন ডোজের জন্যে ইংল্যান্ড বেশ আগেই ৭০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং আমেরিকা ৩০০ মিলিয়ন অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন ডোজের জন্যে গত মে মাসেই ১.১২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।ফাইজার কোম্পানীর প্রথমদিকের ভ্যাকসিনও আমেরিকাই নিবে।Serum Institute of India বলেছে,ভারতকে দেবার পরেই তারা রপ্তানির বিষয় বিবেচনা করবে।প্রথমদিকের উৎপাদিত ভ্যাকসিন এর মূল্য বেশি হবে তা বলাই বাহুল্য। ধনীদেশগুলোর বুঝতে হবে বৈশ্বিক সংক্রমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।নিম্ন অায়ের দেশগুলো ভ্যাকসিন না পেলে বৈশ্বিক সংক্রমন নিয়ন্ত্রন সম্ভবপর নয়।বৈশ্বিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধারও সম্ভব নয়।করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ‘ভাইরাস’ ই সবার শত্রু,কোন দেশ নয়। বিজ্ঞান ই হতে হবে সিদ্ধান্তের ভিত্তি,রাজনীতি নয়।সংক্রমন বিবেচনায় প্রয়োজনানুযায়ী সব দেশ যাতে সাশ্রয়ী মুল্যে ভ্যাকসিন পেতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।সর্বোচ্চ দরদাতার নীতি পরিহার করতে হবে।অতীতে ২০০৯-২০১০ সালে সোয়াইন ফ্লুর ভ্যাকসিন নিয়েও নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে একই অবস্থার মোকাবেলা করতে হয়েছিলো।
৪। ভ্যাকসিন সংগ্রহ একটা জটিল প্রক্রিয়া।ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে সাশ্রয়ী মুল্যে,নিরাপদ,সঠিক মানসম্পন্ন ভ্যাকসিন যথাসময়ে চাহিদা মোতাবেক সরবরাহ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।Single source নির্ভরতা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।ভ্যাকসিন সংরক্ষণের জন্যে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা, একাধিক ডোজ একজনের জন্যে প্রয়োজন কিনা ইত্যাদিও বিবেচ্য।৩০ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন ক্রয়ের জন্যে বাংলাদেশ Serum Institute of India (SII) এবং Beximco Pharma এর সাথে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করেছে।জানা যায়,চুক্তি অনুযায়ী বেক্সিমকো প্রতি মাসে ৫ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন ডোজ প্রতি ৪ থেকে ৫ মার্কিন ডলার মুল্যে SII থেকে কিনবে।সরকার কবে থেকে পাবে,কি দামে পাবে তা জানা যায়নি। প্রতিজনকে ২৮ দিন অন্তর এ ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ করতে হবে এবং
এতে ১৫ মিলিয়ন লোককে দেয়া সম্ভব হবে।সময়মত দ্বিতীয় ডোজ দেয়া বড় Challenge.দ্বিতীয় ডোজ না দিলে বা দেরীতে দিলে ফল কি দাঁড়াবে তা জানা যায়নি।
৫। SII পরিমানের দিক থেকে বিশ্বের সর্ববৃহত ভ্যাক্সিন উতপাদন কারী কোম্পানি।প্রথম ধাপে SII ১০০ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন উতপাদন করবে।ইতোমধ্যে চুড়ান্ত ট্রায়ালের ফলাফলের অাগেই তারা At risk manufacturing and Stockpile লাইসেন্স এর আওতায় ৪০ মিলিয়ন ডোজ উতপাদন করে রেখেছে। অক্সফোর্ড ভ্যাক্সিনের পার্টনার কোম্পানি Ashtra Zeneca,Gates Foundation এবং Global Alliance on Vaccination and Immunization(GAVI) এর সাথে SII এক বিলিয়ন ডোজের অধিক ভ্যাকসিন তৈরীর জন্যে চুক্তি করেছে।অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন(Covoshield) ছাড়াও মার্কিন কোম্পানি Novovax এর ভ্যাকসিন Covovexও উতপাদন করবে SII.
৬। ভ্যাকসিন সংগ্রহ করার জন্যে এর বাজারের গতি প্রকৃতি বুঝা এবং নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভ্যাকসিনের Market dynamics না জেনে ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে গেলে বিশাল অার্থিক ঝুঁকির সম্ভাবনা।মনে রাখা প্রয়োজন,ভ্যাকসিন বিনামূল্যে সাধারন জনগনকে দিতে হবে।১৬ কোটি লোকের দেশে যে পরিমান ভ্যাকসিন দরকার তার অার্থিক সংশ্লেষ বিশাল।ভ্যাকসিনের Market dynamics study এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শের জন্যে বিশেষজ্ঞ গ্রুপ থাকা প্রয়োজন।সারা দেশে ভ্যাকসিন সংরক্ষণ এবং এর প্রয়োগের জন্যে লোকবলসহ যাবতীয় প্রস্তুতি আগেভাগেই নেয়া দরকার।
লিখেছেন
এএমএম নাছির উদ্দীন
সাবেক স্বাস্থ্য সচিব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
বিডিনিউজ ইউরোপ/১৫ নভেম্বর/ জহিরুল ইসলাম