ধারাবাহিক পর্বঃ
____________________________
বাউশের ভোর হতে ( পর্ব -১)
—মাহফুজুল আলম
____________________________
–দোস্ত, আছিস?
–আছি তো বন্ধু।
–তুই কি ফ্রি?
–না, বাচ্চাদের খাওয়াবো এবং নিজেও খাবো। এছাড়া আর কোন কাজ নেই। তুই ঘুমিয়ে পড়বি নাকি? আর ২৫/৩০ মিনিট দিবি? তাহলে কল করে আসবো, বন্ধু।
ম্যাসেঞ্জারে কথা হচ্ছে। এই বাল্যবান্ধবীর সাথে প্রাইমারি স্কুলে একসাথে পড়তাম। প্রায় চল্লিশের কোঠায় এসে হঠাৎ যোগাযোগ। এর মাঝে কোনদিন আমাদের জানা-শোনা বা কথা হয়নি। অবাকের পরও যদি অবাক হতে হয় তবে আজই সেইদিন। ছোট বেলার পর হতে আজ অবধি দু’জনে কথা বলেছি কিনা মনে পড়ছে না। অথচ হরদম তুই-তুমি বলে কথা চালিয়ে যাচ্ছি । কারণ আমরা ক্লাসমেট।
প্রাইমারি স্কুল শেষ করে বিথীকা গার্লস স্কুলে ভর্তি হলো ষষ্ঠ শ্রেনীতে। আর আমি বয়েজ স্কুলে। এরপর এহজনমে আর কখনো একরুমে বসা হয়নি । এমনকি প্রাইমারিতেও কথা হয়েছিল কিনা সেটা হলপ করে বলতে পারি না। এতো বছর পর হঠাৎ-ই যোগাযোগ হলো। আশির দশকের শৈশবে ফিরে গেলাম আমরা।
আমার ব্যস্ততা দেখে সে কি ভাবলো কে জানে। তবে দুই-একদিন কথা বলার পরেই জেনে গেছে যে আমার স্ত্রী চাকুরী করেন। এই সময়টা আমাকেই বাচ্চা সামলাতে হয়। প্রবাসে আত্মীয়-স্বজন অথবা চাকর-বাকর পাওয়া যায় না। তাই খুব তাড়াতাড়ি করে শান্তনা দিতে আমাকে বলে ফেললো,
–সিওর। ওকে। না হয় কাল কথা বলবো। কোন সমস্যা নেই বন্ধু। তুমি ফ্রি হয়ে নক করো।
— না, তা কেন বন্ধু? জাস্ট কয়েক মিনিট সময় দাও। তুমি কল করলে আর আমি ব্যস্ততা দেখাবো এটা কি হয়?
সব গুবলেট হয়ে যাচ্ছে দু’জনের। কখনো দোস্ত, কখনো বন্ধু, কখনো তুই, কখনো তুমি। এই সমস্যা নিয়ে যখন কথা চলছে তখন একটু পেছন হতে ফিরে আসা যাক।
ছাত্র হিসেবে আমি সভ্য-শান্ত ছিলাম বলে অনাত্মীয়দের অভিযোগ ছিল। পাশাপাশি যোগ হয়েছে লাজুকতা। সেইসুত্রে আমার মনে পড়ে না আমি কোনদিন ওর সাথে কথা বলেছি কিনা । শুধু একটাই ভরসা। তা হচ্ছে, প্রাইমারি স্কুলমাঠে আমরা খুব খেলতাম। তখনকার সময় ছেলেমেয়েরা একসাথেই খেলতো। ভাই-বোনের মত বন্ধু-বান্ধবীরা সব মিলেমেশে একাকার। এখনকার দিনে প্রাইমারিতে এই রেওয়াজটা খুবই কম। বিশেষ করে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেনীতে তো শূন্যের কোঠায়। এখনকার ছেলেমেয়েরা একসাথে খেলাধুলা করে না।
দাড়িয়াবাধা, গোল্লাছুট, বউচি, বরফ-পানি ইত্যাদি কয়েকটি খেলা ভীষণ জনপ্রিয় ছিল আমাদের। এই সবগুলো খেলা একই সাথে অনেকজন মিলে খেলতে হয়।
তাই মনে হলো, কোননা কোনদিন বিথীকার পিঠেই হয়তো আমার চড় পড়েছে। আমিও হয়তো খেতে পারি কয়েকটা । এমনও হতে পারে দু’জনের ঝগড়া লেগে কথা বলা বন্ধ হয়েছিলো খুব নিরবে। আসলে কিচ্ছু মনে নেই। তাই এই কনভার্সেশনটা খুব কঠিন হচ্ছে ।
যাগগে, ২০২১ সালে এসে আমাকে খুঁজে বের করলো সেইদিনকার পুঁচকু মেয়েটা। আমি ভীষণ আপ্লুত শৈশবে ফিরে যেতে পেরে।
মোবাইলে আবার ম্যাজেজ এলো,
–আরে ঠিক আছে, আমি লজ্জিত বন্ধু। তোমাকে শুধু শুধু বিরক্ত করছি। খাওয়া শেষ করো ঠান্ডা মাথায়। বাই বাই।
বলেই কেটে পড়লো। আমি আবারও ফিরে গেলাম আমার শৈশবে। প্রাইমারিতে কথা যদি নাইবা হয় তাহলে তার সাথে বালিকা বিদ্যালয়ে গিয়ে কথা বলবো? এটাও কি সম্ভব? না, মোটেও নয়।
নবম শ্রেনীতে গিয়ে প্রথম জড়তা ভাঙ্গে। সাইন্সের ছাত্র হিসেবে ইলেক্টিভ ম্যাথ করতে যেতাম নিত্য স্যারের বাড়িতে। তখন শ্রিপ্রা নামে সাইন্সের একমাত্র ক্লাসমেট বান্ধবী একদিন বলে উঠলো, “মাহফুজ, তোর খাতাটা দে। গতকাল আমি আসিনি। অংক তুলতে হবে।”
এটা দিয়েই শুরু। তারপর আস্তে আস্তে ক্লাসের বাকি মেয়েদের সাথে কথা বলার পরিচিতি ঘটলো। দীর্ঘ আট বছর পর ক্লাস নাইনে এসে যে ছেলে সহপাঠি মেয়েদের সাথে কথা বলা শুরু করতে পারে সে কতটা লাজুক ছিল তা নিশ্চয়ই অনুমেয়।
তবে আজ হঠাৎ এই মধ্যবয়সে আমাকে কি কারণে খুঁজে বের করলো বিথীকা? ঠিক মিলছে না। আমি তাকে চিনতাম ভিন্নরূপে। আমার চোখে পরিচিত কিন্তু ওর চোখে আমি বয়েস স্কুলের ইয়ারমেট। তাও আবার বন্ধু-বান্ধবীরা একসাথে হলে টের পেত। অথচ বালিকা বিদ্যালয়ে সবচেয়ে সুন্দরী হিসেবে পরিচিত বিথীকাকে কে না চিনতো ? বেশ কদর করতো সব ছেলেরা। কত বন্ধু, বড় ভাই, কত ছাত্রদের মুখে শুনেছি বিথীকার বর্ননা। একদিকে গার্লস স্কুলের সেরা ছাত্রী, অন্যদিকে সুন্দরী। ওকে কেউ চিনবে না, তা কি হয়?
আমার সব মনে আছে কিন্তু আমি যে ওর ব্যাচেমেট ছিলাম তা সে মনে রাখেনি। কিন্তু আজ শৈশবের মরিচিকা ওকে নস্টালজিক করছে। হয়তো সেজন্যই ছোটবেলার সহপাঠীদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। বাউশে ধোঁয়াশার কুয়াশা ভোরে হাতড়ে বেড়ায় ওর ১৬ বছর বয়সের বালিকা মন । কয়েক টুকরো কথায় আমি স্পষ্ট বুঝতে পেলাম বিথীকা কি খুঁজছে।
খাওয়া-দাওয়া শেষ। ফিরে এসে ম্যাসেজ করলাম,
–টোটালি ফ্রি, বোন। সো সরি, তোমার কথা শোনাই হলো না। এদিকে আমাকে ছুছুবাবা হিসেবে প্রক্সি দিতে হলো। কিছু মনে করো না। দেখো দেখি কি কম্য! (ছোট ছেলেটা বাথরুম সারলো। ওকে ছুছু করিয়ে ফিরে এসে লিখলাম। সেই কথা শুনে মনে হলো বিথীকা হাসতে হাসতে পেট ফেটেই মরে যাবে।)
বিথীকা উত্তর দিল,
–হা হা হা। দারুণ লেগেছে!
–ধরাশায়ী বুঝি একেই বলে? মান-সন্মান সব ছুছু করাতে গিয়ে চলে গেলো। আর তুমি হাসছো?
–আজ থেকে তোমার নাম “ছুছুবাবা”।
–আমার মান-সন্মান সব বেহেস্তে গেলো। তাও আবার বান্ধবীর কাছে? আমি তো আর আমার মাঝে নেইরে, দোস্ত!
এদিকে বিথীকার পেটে খিল লেগে গেছে। লাগবে না কেন? প্রাইমারিতে পড়া সহপাঠীর সাথে এতদিন পরে চ্যাটিং হচ্ছে। সেই মূহুর্তে বাচ্চা হাগু করে দিয়েছে। সেটা শুনে পৃথিবীর যে কোন মেয়ে একজন পুরুষের অসহায়ত্বের সুযোগ তো নেবেই। কি যে মজা, যিনি পেয়েছেন শুধু তিনিই জানেন।
ছেলে আমার পা দিয়ে সেটা চটকাচ্ছে। দেখে পাশে বসে পড়লাম। বললাম, বাপরে আর কিছু করার বাকি আছেরে বাপ? ছেলে কথা বলে না। শুধু বলে, “ধোঁয়ায় তাও (দাও)”।
এদিকে বন্ধবী আমার সেটা বোঝে না। খালি হাসে। এসব সামলাতে গিয়ে আমি নেমে-ঘেমে একাকার!
আসলে বাচ্চার মা বাসায় নেই। তখন পৃথিবীর কোন পলোয়ান আছেন যিনি এই মূহুর্তে এসব পরিষ্কার না করে বান্ধবীর সাথে শৈশব আওড়াবেন?
আমার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললাম,
–“নিজের প্রেস্টিজ সব গেলোরে বাপজান। আরে বাপধন, খবর করবি কর কিন্তু সারা জীবনে যাহার (বিথীকার) টিকিটি মাড়াইতে হইনি, গপ্প হয়নি, হয়নি হাস্যরস কিছুই। অথচ বাজান তোমার ধামাকা (হাগু) আসিয়াবার আর সময় হইলো না? খামাকা আমার ইজ্জতটা পাঞ্চার করিবার কি খুবই দরকার ছিল? সবশেষে আমি তো তোমার বাবাই হই, তাই না বাজান?”
আড়াই বছরের ছেলে সে কি আর কিছু বলবে? নাকি কিছু বুঝবে? আমার সাধু ভাষায় কথা বলার ধরন দেখে ভেবাচেকা খেয়ে অপরাধির মত তাকিয়ে রইল। আমিও নিরিহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম- ধামাকা এবং আমার পুচকুর দিকে।
(চলবে …)
বিডিনিউজ ইউরোপ২৪ডটকম/১২অক্টোবর/জই