কুতুব মিনার–শাহী দিল্লি আইকনিক স্থাপত্য, ইট–লাল বেলে পাথরে বানানো বিশ্বের সর্বোচ্চ উচ্চতার (২৩৮ ফুট) মিনার। ইতিহাস–পাঠ্যে আমাদের চেনা–জানা, অনেকেরই সচোখে দেখা। রাজপুত রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানের বিরুদ্ধে সুলতান মুহাম্মদ ঘোরির বিজয় উদযাপনের স্মারক হিসেবে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে গড়েছিলেন তাঁর সেনাপতি (পরে দিল্লি সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা) কুতুবউদ্দিন আইবেক (রা. ১২০৬–১২১০)। বিজয়ের স্মারক আর কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে; মুসলিম ঐতিহ্য ও ইসলামিক স্থাপত্যের অনবদ্য নিদর্শনটি।
এর অল্প দূরেই প্রাচীন শহর মেহরৌলি, সাতটি মধ্যযুগীয় শহরের একটি, যা বর্তমান দিল্লি রাজ্য গড়ে। আইবেকের এক সময়ের রাজধানী মেহরৌলি, যা এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবহেলিত প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ও ক্ষয়িষ্ণু প্রাসাদসহ অতীতের অবশিষ্টাংশের সঙ্গে সরু ঘূর্ণায়মান গলির ঘনবসতিপূর্ণ ব্যস্ত জনপদ। রাজপুত, সালতানাত, মুঘল আর ঔপনিবেশিক আমলের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল নিদর্শনটি উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফি সাধক, চিশতিয়া তরিকার পণ্ডিত হযরত খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীর (রা.) দরগাহ ও সমাধি। ৮০০ বছরের বেশি সময় ধরে যে দরগাহ একতা আর সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উচ্চ:স্বরে বার্তা দিয়ে যাচ্ছে শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের, ভূমিকা রাখছে সকল ধর্মের মধ্যে সমপ্রীতি রক্ষায়। ভালোবাসা, সহিষ্ণুতা, উদারতা শিক্ষার জন্য হিন্দু–মুসলিম–শিখ সকল সমপ্রদায়ের কাছে পরম শ্রদ্ধেয় ১৩ শতকের মহান সাধকের এই সমাধি–দরগাহ কাছে টানে সকলকেই, যে টানে আমারও যাওয়া হয়েছে দু’বার।
২০১৯ সালে কাফেলার সঙ্গে শেষবারের অভিজ্ঞতা ছিলো একেবারে অন্যরকম, জানার পরিধির সঙ্গে বেড়েছে অনেক আগ্রহ। গ্রন্থ, নিবন্ধ, গবেষণার ইতিহাস ঘেঁটে হয়েছি আরও সমৃদ্ধ। সে বছরের মধ্য আগস্টে ভারতে দশ দিনের ‘পবিত্র সফর’ শুরু হয়েছিল দিল্লি দিয়ে, কাফেলার প্রথম গন্তব্য ছিল এ ঐতিহাসিক সমাধি–দরগাহ। আয়োজনটা ছিল চট্টগ্রামের ডায়মন্ড সিমেন্টের। প্রতিষ্ঠানটির বিপণন অংশীদারদের (নির্মাণ সামগ্রী ব্যবসায়ী) সঙ্গে মিডিয়া পরামর্শক হিসেবে আমি আর অতিথি হয়েছিলেন কয়েকজন অনুজ সংবাদকর্মী। ইতিহাস–ঐতিহ্য নিয়ে প্রচণ্ড আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের পরিচালক লায়ন হাকিম আলীর তত্ত্বাবধান ও নেতৃত্বে সফরটি সাজিয়েছিলেন বিপণন প্রধান আবদুর রহিম। দিল্লি থেকে হরিয়ানা–পাঞ্জাব–উত্তরখণ্ড–উত্তরপ্রদেশ–জয়পুর (আজমীর) হয়ে পশ্চিমবঙ্গ; সুযোগ হয় অনেক প্রখ্যাত সুফি সাধকের সমাধি দেখার।
ইসলামের অভ্যন্তরীণ রহস্যময় মাত্রায় সংজ্ঞায়িত সুফিবাদের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে দিল্লির দাবি প্রায় এক হাজার বছর আগের। বিশেষ করে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ সুফি সাধক হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রা.) এবং কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রা.) দিল্লি সালতানাত প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁরাসহ আরও অনেক সুফি সাধক উত্তর ভারতে ইসলাম প্রচারের পাশাপাশি সামপ্রদায়িক সমপ্রীতিতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন, হিন্দু ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাংস্কৃতিক মিথষ্ক্রিয়ায় প্রধান অনুঘটক ছিলেন। ফলে সাধকদের দরগা–সমাধি মুসলিম ছাড়াও হিন্দু–শিখসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান হয়ে ওঠে, আজও আকর্ষণ করে চলেছে। বিশেষ করে, চিশতীয়া সাধকরা তাদের জীবদ্দশায় এবং পরে অনেক জনপ্রিয় হয়েছিলেন। যার মধ্যে দিল্লিতে কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী, নিজামুদ্দিন আউলিয়া, নাসিরুদ্দিন চিরাঘ–ই–দেহলভীসহ কিছু সুপরিচিত দরগাহ রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনো তরিকার অনুসারী না হলেও, শ্রদ্ধা–সম্মান সবার প্রতি। তবে, আধ্যাত্মিকতা আর অলৌকিকতাকে ছাপিয়ে অসামপ্রদায়িক চরিতের এমন মহান সাধকরা আমাকে প্রাণিত করে, কাছে টানে। আজ বড্ড বেশি অনুভব করি তাঁদের প্রয়োজনটাও!
চট্টগ্রাম থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে আগরতলা, সেখান থেকে আকাশপথে দিল্লি। করোলবাগ পর্যটক এলাকায় রাতযাপন, পরদিন সকাল থেকে কাফেলার তাপানুকুল রিজার্ভ বাসে দিনব্যাপী দিল্লী সফর। করোলবাগ থেকে মেহরৌলি বাস স্টেশন, সাড়ে ১৮ কিমি সড়কপথে সময় নেয় ৪৫ মিনিটের মতো। এরপর মেহরৌলির সরু ঘূর্ণায়মান গলিতে হাঁটাপথে ইতিহাসের সঙ্গ। ৪০ জনের কাফেলায় ছিলেন ষোল বছরের কিশোর থেকে আশির উপরের বয়োজেষ্ঠ্যও। সঙ্গী ছিলেন দু’জন পথপ্রদর্শকও, কর্ণফুলীর ইছানগর আবদুল হাকিম জামে মসজিদের খতীব মাওলানা মো. মহিউদ্দিন আলাভী ও চট্টগ্রাম জেলা বারের আইনজীবী মাওলানা মোকতার আহমেদ। সুফি সাধকদের নিয়ে দু’জনই অভিজ্ঞ, অনেকবার সফর করেছেন ভারতজুড়ে থাকা বিখ্যাত সমাধি–দরগাহ। তাদের সুন্দর বর্ণনায় জানা হয় অনেক ইতিহাস।
দরগাহ কমপ্লেক্সে ঢোকার অনেকগুলো পথ। আমাদের কাফেলা ঢোকে প্রধান পথেই। বেশ সরু গলি, মানুষে মানুষে গায়ে গায়ে লেগে যায়। দু‘পাশে গিলাফ, ফুল, আতর, মোমবাতি–আগরবাতি, টুপি–রুমালসহ নানা ধর্ম প্রসাদের দোকানের সারি। পুণ্যার্থীদের অনেকে কেনাকাটায় ব্যস্ত, দু’একজন সুন্দর সাজানো ফুলের থালি মাথায় নিয়ে দরগামূখী। বাজার যেখানে শেষ, সেখান থেকে শুরু দরগাহ কমপ্লেক্স। কিছু পরেই দেয়ালে লাগানো একটি পাথর ফলকের সামনে দাঁড়িয়ে গাইড মাওলানা মোকতার জানালেন, এটি হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া (রা.)-এর জিয়ারতের স্থান, যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি কুতুব সাহেবের কবর জিয়ারত করতেন, পীরের প্রতি অনেক ভক্তি–শ্রদ্ধায় কখনো কবরের কাছে যেতেন না। হাকিম ভাইয়ের অনুরোধে মোনাজাত ধরেন মাওলানা মহিউদ্দিন। উঁচু টিলার উপর দরগাহ কমপ্লেক্স, সাদা মার্বেলের সাত ধাপের সিঁড়ি টপকিয়ে উপরে উঠতেই আরেকটি প্রবেশপথ, পারস্যের মিনাকারীর অলংকারিক নকশার নান্দনিক খিলান। ঢোকার পরেই জটিল পথের শুরু। এরপর লম্বা বারান্দা, বাম দিকে পাঁথুরে বাঁধানো সমাধির সারি, ডানে সাদা মার্বেল দেয়ালে ঝালি পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে জিয়ারতে ব্যস্ত মহিলা পুণ্যার্থীরা। কেউ কেউ ঝালির ফাঁকে লাল সুতলি বাঁধছেন এ বিশ্বাসে,’সাধক যদি ইচ্ছা পূরণ করেন’। কবরের সামনে মহিলা ভক্তদের যাওয়ার অনুমতি নেই। দেয়ালের পাশ থেকেই তাদের জিয়ারত সারতে হয়, ঝালি দিয়ে পরিষ্কার দেখা যায় হযরত কাকীর সমাধি।
কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার (জন্ম ১১৭৩–মৃত্যু ১২৩৫) আসল নাম বখতিয়ার, পরে কুতুবউদ্দিন উপাধি যুক্ত হয়। অলৌকিক ঘটনায় কাকি নামটি আরোপিত, তুর্কি ভাষার কা’ক মানে রুটি। দিল্লিবাসীর কাছে ’কুতুব সাহেব’ নামেই বেশি প্রচারিত। তিনি ছিলেন খাজা মঈনুদ্দীন চিশতীর প্রধান শিষ্য ও তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরসূরি। গুরুর ইচ্ছায় দিল্লিতে থিতু হয়ে চিশতিয়া তরিকার স্থায়ী প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা রাখেন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত শিষ্য ও আধ্যাত্মিক উত্তরসূরি শেখ ফরিদুদ্দিন গঞ্জ–ই–শাকর (বাবা ফরিদ), যার শিষ্য–উত্তরসূরি নিজামউদ্দিন আউলিয়া। আবুল ফজলের ‘আইন–ই–আকবরী’ অনুসারে, এক সময়ের ট্রান্সঙানিয়া, বর্তমান কিরগিজস্তানের ছোট শহর উশ থেকে দিল্লি এসেছিলেন বখতিয়ার কাকী। তিনি সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশের (১২১১–১২৩৬) সময়ে দিল্লিতে ছিলেন, যিনি তাঁর শিষ্য হয়েছিলেন, পীরকে উচ্চ মর্যাদার আসনে রেখেছিলেন। কুতুব মিনার তাঁরেই নামে উৎসর্গ করেছিলেন সুলতান, এমনও দাবি আছে।
সোনা–রুপার প্রলেপে মিনাকারী–কাশিদার আলংকারিক কারুকাজের দৃষ্টিনন্দন তৃতীয় দরজা পার হতেই সমাধি চত্বর। উপরে খোলা আকাশ, চারদিকে সাদা মার্বেলের উচু দেয়ালে ঘেরা চত্বর। পাথরে বাঁধানো ছোট বড় অনেক সমাধি, ফাঁকে সাধকের অনুশীলনের ছোট বড় কয়েকটি নিম গাছ। পশ্চিমের দেয়ালের মাঝ বরাবর অনেক সুন্দর গম্বুজসহ অলঙ্কারিক স্তম্ভের উপর মার্বেল কাঠামোর দৃষ্টিনন্দন সমাধিসৌধ, যেখানে চিরবিশ্রামে মহান সাধক কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রা.)। চকচকে সোনালী, রক্ত লাল, উজ্জ্বল রূপালী এবং গাঢ় নীল রঙে আঁকা প্রাণবন্ত সমাধিসৌধে চোখ–মন জুড়ে যায়। ১২টি খাঁজ–কাটা কলামের সুন্দর প্যাভিলিয়নের নিচে আয়তকার মার্বেল বালস্ট্রেড (পিল্লা–লাগানো রেলিং) ঘেরে থাকা কবরটি সিকুইন (ক্ষুদ্রাকার ঝলমলে রূপার চাকতি) আর রঙিন পুতিতে বর্ণিল কাপড়ে ঢাকা। সমাধিটির সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বিশাল বাল্বস গম্বুজটির সোনার প্রলেপ কারুকাজের মিনারশীর্ষ, যা একটি পূর্ণ ফোঁটা সোনালী ফুলের বিস্ফোরণের মতো দেখায়। গম্বুজের ভেতরটা কাঁচের কাজ, রঙিন আরবি ক্যালিওগ্রাফি আর জ্যামিতিক শৈলীতে সাজানো। গম্বুজ থেকে বড় একটি এবং চারপাশে ছোট চারটি ঝাড়বাতি ঝুলানো। বিভিন্ন গ্রন্থ–তথ্য বলছে, কুতুব সাহেবের ইচ্ছে ছিল, খোলা আকাশের নিচে নির্মল পরিবেশে একেবারে সাধারণ সমাধিতে শান্তির চিরবিশ্রাম। প্রতিফলনও করেছিলেন তাঁর প্রধান খলিফা ও উত্তরাধিকারী শেখ ফরিদউদ্দিন মসউদ গঞ্জেশকর (বাবা ফরিদ)। মাটির ঢিবির উপর চাঁদরে ঢাকা একেবারে সাধারণ সমাধি গড়েছিলেন তিনি। পরে যুক্ত হয়েছিল কাঠের রেলিং। কিন্তু বছরের পর বছর সংযোজন–পরিবর্তনে বর্তমান মার্বেল কাঠামোর দৃষ্টিনন্দন রূপটি নেয়। বর্তমান আকার ১৯৪৪ সালে সম্পূর্ণ হয়েছিল, যেখানে শাসক–ভক্তরা ভ্থমিকা রাখেন।
সমাধির চারপাশজুড়ে নানা বয়সের অনেক পুণ্যার্থীর উপস্থিতি, মুসলিম ছাড়াও হিন্দু–শিখ ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষ। দাঁড়িয়ে–বসে জিয়ারত করছেন মুসলিমরা, ভক্তিতে নিমগ্ন অন্য ধর্মাবলম্বীরাও। কেউ সমাধিতে গোলাপ জল–ফুল ছিটাচ্ছেন, কেউ গিলাফ জড়াচ্ছেন। আবার অনেকে পাশের সুন্দর দানিতে মোমবাতি জ্বালাচ্ছেন, কেউবা আগরবাতির সুবাস ছড়াচ্ছেন। সব ধর্মের তীর্থযাত্রীদের এমন ভক্তি জানান দেয়, সাধক তাদের ওপর কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। বলাবাহুল্য, আমাদের কাফেলাতেও আছেন একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী ভাই, ডায়মন্ড সিমেন্টের কর্পোরেট ম্যানেজার দীপ্তিমান দাশ; নিজের একান্ত ইচ্ছায় সঙ্গী হন মুসলিম সাধকদের দরগাহ দর্শনের এ কাফেলায়, আমরা খুঁজে পাই সাধকের অসামপ্রদায়িক প্রকৃতির উদাহরণ! ঐতিহাসিক দরগাটিতে সাধক, শাসক, অভিজাতসহ প্রায় শতাধিক সমাধি ছাড়াও অনেক নিদর্শন রয়েছে, এ নিয়ে বিস্তারিত পরের পর্বে। (চলবে)
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক এজাজ মাহমুদ, সম্পাদক আকাশ যাত্রা।
বিডিনিউজ ইউরোপ ২৪ডটকম/১৯এপ্রিল/জই