জীবন হতে নেওয়া সত্য ঘটনা অবলম্বনে গল্পঃ অবুঝ কষ্টের ভাঁজে রচনাঃ মাহফুজুল আলম
১.
ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ। সকাল ০৯:০৮ বাজে। আমি অফিসের কাজে তখন খুব ব্যস্ত। একটা নোটিফিকেশন এলো ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে। সামান্য তাকালাম। দেখলাম এই আইডিটি অপরিচিত। তারও বেশ খানিকটা সময় পর অপেন করলাম পুরো ম্যাসেজটি। দেখলাম তিনি লিখেছেন,
— তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছো ?
আমি লিখলাম,
— জ্বী না।
— আমি “বিন্দু” (ছদ্দনাম)। অমক (নামটা গোপন রাখলাম) খালার ভাগ্নি। ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা গার্লস স্কুলে পড়লেও আমাদের বাড়ি ছিলো আলিপুরে।
হিসেব কষে দেখলাম তিনি আমার বড় বোনের ক্লাসমেট। তবে তাদের স্কুল ছিলো ভিন্ন। বললে হয়তো আমার বোনকে তিনি চিনলেও চিনতে পারেন। যাইহোক, আমি তখনও বুঝিনি যে এই প্রবাসী এবং অপরিচিত ছোট ভাইটির কাছে কি বলতে চান বা যোগাযোগের কারণটা কি। এরমাঝে বেশ কিছু কনভার্সেশন হলো কিন্তু কোন ভাবেই আমি তাকে চিনতে পারছি না।
হঠাৎ বললেন,
— তুমি আমাকে দেখেছো কখনো?
আমি পুরোপুরি ভড়কে গেলাম। কারণ আমি এর আগে তার মুখ হতে বলা একজন টিচারের নাম শুনে বলেছিলাম যে আমি তাঁকে খুব ভালো করেই জানি। আর তাই হয়তো তিনি আমাকে হঠাৎ এই প্রশ্ন করে বসলেন।
এখন আমার যেন কেমন মনে হচ্ছে। ঠিক স্বাভাবিক মনে হয়নি পুরো কনভার্সেশনটি। নিজ এলাকার পরিচিত শেকড়ের কথা বললেন বলেই স্বাভাবিকভাবে কথা চালিয়ে যাচ্ছি।
তারপর তার প্রশ্নের জবাবে বললাম,
— আমি লাজুক ছিলাম। গার্লস স্কুলের মেয়েদের সাথে কথা বলার মত বুকের পাটা ছিলো না। যেমন : গার্লস স্কুলের আমার এক বান্ধবী (নাম উল্লেখ করে বললাম) তার সাথে আমি প্রাইমারিতে পড়েছি। অথচ সে আমাদের প্রাইমারি হতে গার্লস স্কুলে চলে যাওয়ার পর আর কোন দিন কথা হয়নি। গত দু’মাস আগে সে আমাকে খুঁজে বের করেছে। অতএব আপনার সাথে আমার মনে হয় না কখনো পরিচয় ছিলো। থাকলে মনে থাকতো।
তিনি পুরোপুরি নিরাস হলেন। সেই হতাশার পরও আমাকে কি যেন বলবেন বলবেন করছেন। আর আমিও তাড়াহুড়া করছি শোনার জন্য কিন্তু তাকে বুঝতে দিইনি। হাতে প্রচুর কাজ। মোবাইল টিপে ম্যাসেজ করার সময় নয় এটি। তবুও ভদ্রতার খাতিরে আমার কোন কিছুই বলা হলো না। আমি জানি না কেন আমার মনে হলো যে, তিনি কিছু একটা বলে হালকা হতে চাইছেন।
এই ফাঁকে তার প্রোফাইলে ঢুকলাম। দেখলাম একজন খুব সাদাসিধে, সরল একটি মানুষের ছবি। পাশে অপৌড় একজন। তবে মাঝ বয়সের চেয়ে একটু বেশি হবে এমন একজন ভদ্রলোক। আর সাধারণ পাঁচটা পরিবারের বাবা-মায়ের মতই দেখতে। খুব একটা মায়া হলো। এ যেন সরল জীবনের সাদাসিধে দু’টি প্রাণ।
আবার কনভার্সেশনে ফিরে এলাম। বললাম,
— কিছু বলতে চান? চাইলে বলতে পারেন খোলা মনে। আমি মন দিয়ে শুনবো। (মানে পড়ে উত্তর দেবো।)
এরপর তিনি যা লিখলেন তার জন্য আমি কখনোই প্রস্তুত ছিলাম না। আমি কখনো ভাবতেও পারিনি যে আমার কোন পাঠক এভাবে আমার কাছে কিছু বলতে চাইবেন। আমি পুরোপুরি নির্বাক হয়ে রইলাম কতক্ষণ। আর তিনি হয়তো ভাবলেন অফিসের ফাঁকে তাকে যে উত্তর দিচ্ছি এটাই যথেষ্ট। তিনি লিখেছিলেন,
— আমার বড় মেয়েটা গত ৩০শে এপ্রিল মারা গেছে। জানো, আমার মনে অনেক কষ্ট।
আমি বেশ কয়েক মিনিট উত্তরই দিলাম না। আমি শুধু ভাবছি, মানুষ কতটা কষ্ট পেলে, কতটা অসহায় হলে, কতটা বুকের ভার কমাতে চাইলে জীবনে যার সাথে পরিচয়ই নেই তার কাছে কিছু বলার জন্য ফেসবুকে পরিচিত হতে চান।
আমি নির্বাক তখনো। কারণ আমার ধারণা ভুল হয়নি। আমাকে কতদিন ফলো করার পর একজন মা তার হাহাকার করা বুক নিয়ে একটি সিদ্ধান্তে এসেছেন। একই ব্যথার ঘুরপাক খাওয়া জটলা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন একা একা। এক ঢোকে গিলে ফেলতে না পারা কষ্টের ব্যথা নিয়ে কতজনের সাথেইনা কথা বলেছেন। একই কথা ক’বার শুনবেন পরিচিতজনেরা? তাই হয়তো এসব মায়েরা নতুন শ্রোতা খোঁজেন। একটু আত্মতৃপ্তির জন্য কাঁদতে চান মন খুলে। যেন কেউ তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনেন। তাতে কতটুকু কষ্ট লাঘব হচ্ছে আমি জানি না। জানি না বলেই তার জানা কষ্টের ভাগ নিতে প্রস্তত হই মনে মনে।
তিনিও তার অতৃপ্তি বলার পেছনে খেটে যাচ্ছেন। কতটুকু তৃপ্তি মিটবে তার হিসেব নেই, জানি। শেষে কিনা ফেসবুকে কোন এক অখ্যাত কলমীর কাছে নিজের কষ্টের দমফাটা আর্জি সেয়ার করতে হলো। বলতে চান হাউমাউ করে, একই কথা বারবার বলে, না বলা কথার মত নতুন করে আরো একবার, ঢুকরে কেঁদে ওঠা শব্দ দিয়ে বহুবার বলতে চান, “আমার মেয়েটি আল্লাহ্ নিয়ে গেছেন, মাহফুজ”।
কাঁদতে চেয়েও হয়তো কাঁদতে না পারা এক মা; অন্তত আজ আমার কাছে। বলতে চেয়েও বলতে পারছেন না কত কিছু। হয়তো এভাবেই বলতে পারলেন না, “ভাই আমার, তুমি একটু কল বেক করো। অনেক কথা বলার আছে।”
মন চাইলেও সেটা হয়তো মুখ দিয়ে বের হলো না কারণ আমরা আজই পরিচিত হলাম; তাও আবার ম্যাসেজে।
তার লিখনীর মাঝে কান্নার সুতোয় টপটপ করে পড়ে নোনা তরলের ফোঁটা দেখতে পেলাম। মনের অজান্তেই হাতের উল্টো পিঠ গিয়ে পড়লো আমার চোখের পাতায়। মায়েদের কান্নার কি শক্তি, কি তেজ, কি মুচড়ে দেওয়া আবেদন! সেই তেজের অতিমাত্রায় শক্তিমত্তার এক ভাঙ্গনে কুপোকাত হয়ে গেলাম আমি। অরক্তীয় এক বায়বীক সম্পর্কে জড়িয়ে গেলাম খানিকটা সময়ের জন্য।
আমার কোন মেয়ে সন্তান নেই। তবুও মনে হলো, যেন আমার মেয়েটাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। শ্রদ্ধায়, কষ্টে, অনুভূতির সুক্ষ্ম আঁচে আমি আমার হাতের উল্টো পিঠ ভেঁজা-ভেঁজা অনুভব করলাম। পৃথিবীর উল্টো পিঠে বসেই ভিঁজে গেলো একটা ভরা দুপুর।
আসলে অফিসের ফাঁকে ফাঁকে অনেক্ষণ বাদে কনভার্সেশন হলো। সেটা করতে গিয়েই কখন যে দুপুর হয়েছিলো বুঝিনি। বিন্দু আপার ওখানে এখন গভীর রাত। অথচ কি অদ্ভুত কারসাজি খোদা তায়ালার। একই অনুভূতি দিয়ে আমাদের দু’জনকে ঠিকঠাক একই কথা বুঝিয়ে দিলেন তিনি (আল্লাহ)।
২.
এই মূহুর্তে আমার কলিগ মিস্টার ফ্রাংক হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি বেজায় রসিক। আমার পরিস্থিতি বোঝার জন্য এবং সামান্য খোঁচা দিতে আমার কাছাকাছি চলে এসেছেন। আমরা দু’জনেই প্রায় সময়ই খোঁচাখুঁচি করি একে অপরকে। তাই তার সুযোগ নেবার কারণ রয়েছে। তিনি এখন জানেন না কি চলছে আমার মাঝে। তার হাত হতে বাঁচার জন্য আগেই বললাম, “চোখে যে কি পড়লো, মিস্টার ফ্রাং। যাকগে, ঠিক হয়ে যাবে।”
আর মনে মনে বললাম, “আহ্ আমার পরোয়ারদিগার, ওনাকে (বিন্দু আপাকে) এই শোক সইবার শক্তি দাও।”
অনেকক্ষণ সময় হলো কোন কথা হচ্ছে না। মনে পড়তেই আমি লিখলাম,
— ইন্নেলিল্লাহ… রাজেউন। আল্লাহ আপনার মন শান্ত করুন। আপনি কি আমাকে কিছু সেয়ার করতে চান, যা করলে আপনার ভালো লাগবে? যদি এমন হয় তো লিখে পাঠাতে পারেন। আপনার সাথে কনভার্সেশনের পুরোটা সময়ই আমার অফিস টাইম। আমি পড়ে নেবো বা পরে উত্তর দেবো। আপনি জানাতে পারেন।
তিনি লিখলেন,
— তুমি কোথায় থাকো?
আমি প্রবাসে দেশটির নাম বললাম। বুঝলাম তিনি অনেকদিন যাবত আমাকে ফলো করলেও জানেন না যে আমি প্রবাসী। আমার কোন-না-কোন লেখাতে তার হয়তো কোথাও দাগ কেটেছে। তাই হয়তো আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন। যাইহোক, এবার তিনি বললেন,
— মাহফুজ ভাই আমার, আমার মনে অনেক কষ্ট। আল্লাহ আমাকে ভালো রেখেছিলো। আমার তিনটা মেয়ে। বড় মেয়েটাকে আল্লাহ নিয়ে গেলো।
একটু থেমে আবার বললেন,
— আমার পিয়া তখন থার্ড ইয়ারে । আমরা ওর বিয়ে দেই। ২০১৫ সাল তখন। ওকে বিয়ে দেবার পর একটা সোনা বেবী হয়। ২০২০ সালে এমবিএ শেষ করলো। ২০২১ সালে দ্বিতীয় বেবী হলো। ১০ই এপ্রিল। সবাই খুব খুশি। সব ঠিক ঠাক চলছিলো । বাসায় ফেরার পর হসপিটাল হতে জানালো আমার মেয়েটার কোভিড-১৯ হয়েছে । আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। ৩০শে এপ্রিল আল্লাহর কাছে চলে গেলো আমার মেয়েটা।
আমার বলার ভাষা হারিয়েছি। অফিসের ব্যস্ততার মাঝে তাকে কি বলে শান্তনা দেবো বুঝতে পারছি না। কষ্ট না দিয়ে মোটামুটি বিষয়টি এড়িয়ে গেলে কেমন হয়? পরে তাকে না হয় এক সময় কল করে বলবো, আপা এখন বলেন কি বলতে চান। আমি সেদিন পুরোটা সময়ে মনযোগ দিতে পারনি। ব্যস্ত ছিলাম।
এরপর লিখলাম,
— আপা, আমি আপনার বাংলিশে কনভার্সেশন ভালো পড়তে পারছি না। আমার অফিসে এখন ভীষণ চাপ। দয়া করে ইংরেজি বা বাংলায় লিখুন। কোনকিছু বলতে চাইলে পুরোটা একবারে লিখে পাঠাতে পারেন। আমি আস্তে আস্তে প্রতিটিউত্তর দেবো। তবে দেরি করে করে দিতে হবে কারণ আমার অফিস চলছে এখন।
তিনি বুঝে গেলেন যে আমি সময় দিতে পারছি না। তাই লিখলেন,
— তুমি কিছু মনে করো না, ভাই।
— আমি কিছু মনে করিনি। ভীষণ খারাপ লাগছে আমারও। আপনাকে সময় দিতে পারলে ভালো লাগতো।
— তোমার অনেক সময় নষ্ট করলাম। ভাই কিছু মনে করো না। ভালো থাকো।
— আপনিও ভালো থাকুন। আমি পরে কখনো এক সময় কল করে আসবো আপা। ধন্যবাদ নক করবার জন্য। আল্লাহপাক আপনার মন শীতল রাখুন।
৩.
কয়েকদিন পরের কথা। আমি বিন্দু আপার দেওয়া একটা পোস্ট দেখলাম। ক্যাপসনে লিখেছেন,
“আমার পিয়ার ছোট বাচ্চাটা আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছে। তিনদিনে বাচ্চাটা আমার কলিজা ফুটা করে ফেলেছে। আমি সব সময় দোয়া করি ওরা দুই ভাই যেখানে থাকুক, ভালো থাকে যেন।”
উল্লেখ, ছোট বাচ্চাটি নানির সাথে তিনদিন ছিলো। সে দাদাবাড়ি ফিরে যেতেই অভিমানি নানির আবেগ কষ্টে রূপ পেলো। আর আমিও কেন জানি অদ্ভুভাবে জড়িয়ে গেলাম এসব ঘটনায়। মনে হলো যাকে কোনদিন দেখিনি, চিনিনি, চেনার আগেই যার লাশ কবরে মিশে গেছে, সেই পিয়াকে আমরা কেউ ভুলিনি। অন্তত বাচ্চা দু’টোর জন্য ভুলতে পারছি না।
বিন্দু আপার লেখাটির গভীরতা আমার মর্মে গিয়ে বিঁধলো। আমি যেন মা-হারা এই দুটি ছেলের পিতা হয়ে মুষড়ে পড়ার স্বাদ পাচ্ছি। কতটা কষ্ট পেলে তিনদিনের জন্য বেড়াতে আসা ছোট ছেলেটাকে নিয়ে এমন লেখা লিখতে পারেন একজন সন্তান (পিয়া) হারা মা, তা ভাবছি। অন্যদিকে ছবিতে দেওয়া মা-হারা অদ্ভুত এই দু’টি পুতুলের মত হিরো বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে থাকাটাই আমার কষ্টের কারণ হলো। মনের অজান্তেই নিজের বাচ্চাদের মুখ ভেসে উঠলো ওদের জায়গায়। আমি কল্পনায় দেখতে পেলাম একটি চিত্র। এই অবুঝ দু’টি বাচ্চার জন্য শত আদরের কমতি হয়তো হবে না। কিন্তু মায়ের হাতের পিটুনির পেছনে যে প্রগাঢ় ভালোবাসা সেটা হয়তো কেউ কোনদিনই দিতে পারবেন না।।
লিখেছেনঃ মাহফুজুল আলম বৈমানিক ও প্রখ্যাত লেখক প্রাবন্ধিক,সাহিত্যিক এবং কবি ,ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র।
বিডিনিউজ ইউরোপ২৪ডটকম/২৯মে/জই