অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নে মানুষের অবাধ চলাচলের সুবিধার জন্য তৈরি ‘শেঙ্গেন জোন’ সংশ্লিষ্ট আইনে সংস্কার আনতে চায় ইউরোপীয় কমিশন। তবে কমিশনের প্রস্তাবিত ধারাগুলো পাসের জন্য অবশ্যই ইউরোপীয় পার্লামেন্ট এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর যৌথ সম্মতির দরকার হবে।মঙ্গলবার শেঙ্গেন অঞ্চলের জন্য একটি সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে ইউরোপীয় কমিশন। কমিশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট মার্গারিটিস শিনাস বলেছেন, ‘অতীতের সমস্ত সাফল্যের মতো বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে শেঙ্গেন অঞ্চলকে অবশ্যই শক্তিশালী করতে হবে।’তবে ইইউ কমিশনের এই প্রস্তাবটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা যাবে না। প্রাথমিকভাবে এটি আলোচনার জন্য ইউরোপীয় সংসদে এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলির কাছে উপস্থাপন করতে হবে।যদিও এই প্রস্তাবটিকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রঁ। ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন ২০২২ পর্যন্ত ম্যাক্রঁ ইউরোপীয় কাউন্সিলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন৷তিনি সম্প্রতি অনিয়মিত অভিবাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছেন৷শেঙ্গেন অঞ্চলের বিধান এবং অভিবাসন বিষয়ক সম্ভাব্য পরিবর্তনগুলো ইনফোমাইগ্রেন্টসের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
শেঙ্গেন জোন কি?
শেঙ্গেন জোন মূলত ইউরোপের দেশগুলোতে মানুষের অবাধ চলাচলের সুবিধার জন্য তৈরি একটি নির্দিষ্ট এলাকা। যে কোনো ব্যক্তি শেঙ্গেন চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী সদস্য যে কোনো একটি দেশে প্রবেশ করলে, কোন প্রকার নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই অবাধে সব দেশের সীমান্ত অতিক্রম করতে পারেন।
বর্তমানের শেঙ্গেন জোনে মোট ২৬টি দেশ রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত ২৭টি রাষ্ট্রের মধ্যে ২২টি দেশে শেঙ্গেন জোনের আওতাভুক্ত।
বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, সাইপ্রাস এবং ক্রোয়েশিয়া ইইউ সদস্য রাষ্ট্র হলেও শেঙ্গেন জোনের সদস্যভুক্ত নয়। অর্থ্যাৎ কোন ব্যক্তি এই চার দেশের ভিসা নিয়ে আসলে তাকে শেঙ্গেন জোনে ভ্রমণ করতে আবারো নতুন করে ভিসা নিয়ে নির্দিষ্ট দেশে আসতে হবে।
অপরদিকে ইইউ সদস্য রাষ্ট্র না হলেও নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, আইসল্যান্ড এবং লিচেনস্টাইন শেঙ্গেন অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত দেশ। এছাড়া একটি বিশেষ মর্যাদায় আয়ারল্যান্ডও শেঙ্গেনভুক্ত রাষ্ট্র।
২০১৫ সালের শরণার্থী সংকট, এবং সন্ত্রাসী হামলার হুমকির পর সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বেশ কয়েকটি দেশ বিক্ষিপ্তভাবে সীমান্তে পরিচয় পরীক্ষা পদ্ধতি পুনঃস্থাপন করেছে। সম্প্রতি বিভিন্ন সদস্য দেশ সীমান্তে চলাচলের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করলে শেঙ্গেন জোনের স্বাধীনতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে ।
ফ্রান্স, জার্মানি, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, নরওয়ে এবং সুইডেন ২০১৫ সাল থেকে প্রতি ছয় মাস পরপর সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পরিচালনা করে থাকে। তবে এটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে এবং শেঙ্গেন আইনের একটি অস্থায়ী কোড দ্বারা অনুমোদিত৷
সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের সুবিধা কি?
ব্রাসেলসে ইইউ কমিশন প্রস্তাবিত সংস্কার প্রস্তাবের ফলে একটি সদস্য রাষ্ট্র তার সীমান্ত এলাকায় যেকোনো অনিয়মিত এবং অবৈধ অভিবাসীকে আটক করার সম্ভাবনা উন্মুক্ত হবে। এছাড়া আটক করা অভিবাসীকে তিনি সর্বপ্রথম ইউরোপের যে দেশে প্রবেশ করেছিলেন সে দেশে ফেরত পাঠানোর আইনি ভিত্তি পাওয়া যাবে। বর্তমানে আইনে কোনো ব্যক্তিকে সদস্য রাষ্ট্রের সীমান্ত থেকে আটক করা হলে, শুধুমাত্র সেই ব্যক্তি যে দেশের নাগরিক সেখানে ফেরত পাঠানো যায় যেটি বেশ সময় সাপেক্ষ এবং ব্যয় বহুল।
অপরদিকে আশ্রয়প্রার্থী বিনিময়ের জন্য ডাবলিন চুক্তির আওতায় সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিনিময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান আইনে যেটি সীমান্ত থেকে আটক করা মাত্র সম্ভব নয়।
প্রস্তাবনা অনুযায়ী ইইউ কমিশন দুটি বিশেষ শর্তে সীমান্ত থেকে আটক হওয়া অনিয়মিত ব্যক্তিদের অন্য সদস্য রাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেয়ার অনুমতি দিতে চায়। শর্তগুলো হলো, কোন অনিয়মিত অভিবাসীকে যদি দুই দেশের যৌথভাবে পরিচালিত একটি পুলিশি অভিযানের অংশ হিসাবে গ্রেপ্তার করা হয় অথবা সীমান্তবর্তী দুটি শহর অথবা রাজ্যের মধ্যে বিনিময় চুক্তি থাকে।
সীমান্ত এলাকায় এই পদ্ধতির অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে ইইউ কমিশন সীমান্তে যতটা সম্ভব গণনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এড়াতে চায়। কারণ সীমান্তে গণহারে চেকিং পয়েন্ট বাড়ালে শেঙ্গেন অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ বাজারের সঠিক কার্যকারিতা এবং মানুষ ও পণ্যের অবাধ চলাচল ব্যাহত হবে।
“আজকে আমাদের প্রস্তাবগুলির সাথে আমরা নিশ্চিত করব যে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণগুলি শুধুমাত্র একটি সাধারণ মূল্যায়নের ভিত্তিতে এবং প্রয়োজনীয় সময়ের জন্য একটি শেষ অবলম্বন হিসাবে চালু করা হয়েছে”, বলেছেন ইউরোপীয় কমিশনার ফর অ্যাফেয়ার্স৷ অভ্যন্তরীণ ইলভা জোহানসন৷
ইইউ কমিশনার ইলভা জোহানসন বলেছেন, “যদি এই অস্থায়ী সীমান্ত নিয়ন্ত্রনগুলো ১৮ মাসের বেশি স্থায়ী হয়, তবে সেক্ষেত্রে ইইউ কমিশনকে অবশ্যই সম্ভাব্য ব্যবস্থাগুলোর ব্যাপারে আনুপাতিক মতামত দিতে হবে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এটি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কোন ‘ভেটো নয়’। তবে মনে রাখতে হবে নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া যত বেশি দীর্ঘায়িত হবে, সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে তত বেশি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে হবে। যেটি প্রমাণ করবে, গৃহীত বিকল্প ব্যবস্থাসমূহ যথেষ্ট নয়।”
অভিবাসন সংকটের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী পদ্ধতি
ইউরোপীয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের অঞ্চলের পাশাপাশি তৃতীয় দেশগুলোর ইন্ধনে সৃষ্ট অভিবাসন সংকটেরও জবাব দিতে চায়। যেমন মরক্কো থেকে স্পেন অভিমুখে বিশাল অভিবাসন স্রোত। অতিসম্প্রতি ইইউ সীমান্তে বেলারুশের সাহায্যে সৃষ্ট নাজুক পরিস্থিতি। যেখানে মূলত অভিবাসীদের ভূরাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে বিশেষ ও ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে অভিবাসী আগমনের সংকট মোকাবেলায় সক্ষম করার জন্য আশ্রয় আবেদন নিবন্ধনের সময়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে ইইউ কমিশন। কারণ সম্প্রতি পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া এবং লাটভিয়ায় বেলারুশ থেকে আসা অভিবাসন স্রোতের সম্মুখীন হয়েছে। নতুন প্রস্তাবনার ফলে বিশেষ কোন সংকটকালে অভিবাসন সংকট মোকাবেলা অনেকটা সহজ হবে।
সূত্র -মাইগ্রেন ইনফরমেশন ডেক্স
বিডিনিউজ ইউরোপ২৪ডটকম/৩০ জানুয়ারি/জই