“ব্যক্তি নয়, সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথকে
আমরা ভালোবাসি….”– মাহফুজুল আলম
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নিয়ে কিছু বলার মত পূর্ণাঙ্গ তথ্য, সুত্র বা বাক স্বাধীনতার কোন আক্ষরিক বর্ননা নিয়ে আলোচনা নয় এটি এবং কারো পক্ষে বা বিপক্ষে বলার মত আমার হয়তো সে জ্ঞানও নেই। তাই জাতীয় সংগীত নিয়ে কিছু বলার ধূর্ততা বা সম্যক জ্ঞান আমি রাখি না। তবে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়িটা যে সত্যি সত্যিই বড় রকমের বাড়াবাড়ি কিনা সেটার কয়েকটি তথ্যসূত্র বা উদাহরণ তুলে দেবো আমার সামান্য বক্তব্যের শেষের অংশে। বাকিটা পাঠকের বিচারে রইবে।
তাঁর সকল প্রকার সাহিত্যকর্ম মূল্যায়ণ করা বাঙ্গালি জাতির একান্ত কর্তব্য নাকি ন্যায় সঙ্গত সেটা বিচারের ভার তাদের, যাদের আজ বোধগম্য ও বোধদয় বলে কিছু হচ্ছে। যেখানে ভালো ধানের মাঝেও কিছু চিটা ধান অবশ্যই থেকে যায়। এদেশে ঘাপটি মেরে থাকা রবীন্দ্র পুজারিদের এটা অবশ্যই বোঝা উচিত যে, তিনি প্রজাদের রক্ত চুষে সাহিত্য কর্মে মননিবেশ করা গুনি সাহিত্যিক।
তাঁর ব্যক্তিগত অবদানে তিনি তাঁর সাহিত্য কর্মে অবশ্যই প্রসংশিত হবার যোগ্যতা রাখেন। কারণ সাহিত্য এমন একটি বিষয় যেটা থামাবার সাধ্যি কারো নেই। কিন্তু শোষকের বেশে অবিভক্ত বাংলায় (বর্তমানের বাংলাদেশ)কে নিয়ে তার প্রশ্নবিদ্ধ আওয়াজ এবং প্রকাশ ও প্রকাশ্য অবস্থান ছিল স্বরনীয়। মোটের পক্ষে ১৮ বার বাধা দান করা হয়েছিল যাতে ঢাকায় “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়” না হয়। যাতে কলকাতার চেয়ে এই বাংলার খেটে খাওয়া মানুষগুলো সত্যি সত্যিই মানুষ না হয়ে ওঠে।
কিন্তু কে জানতো ২০১৯ সালে এসে তার সকল কর্মে কিছু সংখ্যক অপকর্মের ফল লেপন করা হবে? আজকের মত একদিন না একদিন ইতিহাস হতে তার সকল আচরণ বেরিয়ে এসে ঠাকুর পুজোর আসন হতে তাঁকে টেনে হিঁচড়ে বের করে এনে পথে পথে মাড়িয়ে যাবে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষগুলো, এটাও কি কেউ জানতেন ? এটাই ইতিহাসের বিচার।
এবার সামান্য তথ্যসূত্র দিয়ে কিছু সংগৃহীত লেখা নিচে উল্লেখ করলাম। যাতে কারো জাতের মর্যাদায় আঘাত না লাগে। অবশ্যই সত্যিটা সত্যি সত্যিই বলে মেনে নেবেন কারণ এই হিন্দু জমিদারদের মতই এই বাংলায় অনেক মুসলমান জমিদারও ছিলেন যারা সত্যি সত্যিই অত্যাচারী ছিলেন। তাহলে ইতিহাসের পাতায় এই জমিদারের জন্য কেন পুঁজোর ঠাকুরের আসন ধরে রাখতেই হবে সেটা সম্যক প্রশ্ন নয় কি?
উল্লেখ্য, বাংলা ভাষার রূপে তাঁর অনবদ্য অবদান সারা জীবনেও বাঙালি শোধ করতে পারবে না। এটা যেমন সত্যি তেমনি বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশের শিক্ষিতদের শিক্ষিত না করার পেছেনেও তাঁর অপরিশোধিত অবদান কাজ করতো যা পরিক্ষিত; এটাও দ্রুব সত্য। যদিও পরবর্তীতে তাঁর খানিকটা মেনে নেওয়া কার্যক্রম দিয়ে হয়তো অনেকেই বোঝাতে সক্ষম হবেন যে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অনেক নমনীয় ছিলেন। ততদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত এবং নিজস্ব আলোয় প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠেছে।
এখানে আমি একবারও বলছি না যে তাঁর লেখা গান জাতীয় সংগীত হিসেবে কি করা উচিৎ। তবে আমি শুধু বলছি ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন। তাহলে তাঁর বাস্তবিক কর্মকান্ডে আজ এসব প্রশ্নের উত্তরের খোঁজ হতো না।
বিশ্বকবি বিশ্ব-অত্যাচারীও ছিলেন কিনা একটু ঘেটে আসা যাক। কথায় আছে “দূর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য”। আমরা কিন্তু পরিত্যাজ্য করতে পারিনি বরং সাহিত্যিক ও কবি মানসপটে তাঁকে আমরা ধারণ করেছি মনে-প্রাণে। তাই সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথকে আমরা সত্যি সত্যিই ভালোবাসি। এবার চলুন নিচের অংশটি পড়ে ফেলি।
নিচের অংশটি সংগৃহীত তথ্য হতে হুবহু তুলে ধরা হলো…..
১) “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সামন্তবাদী প্রজাদের নিপীড়নকারী জমিদার ছিলেন। তার দফায় দফায় খাজনা বৃদ্ধি এবং জোর-জবরদস্তি করে তা আদায়ের বিরুদ্ধে ইসমাইল মোল্লার নেতৃত্বে শিলাইদহে প্রজাবিদ্রোহ হয়েছিল।
সূত্র:অধ্যাপক অমিতাভ চৌধুরী, জমিদার রবীন্দ্রনাথ, দেশ ১৪৮২ শারদীয় সংখ্যা
২) চারিদিকে নিষ্ঠুরতা ও দুর্নামের প্রতিকূল বাতাসকে অনুকূল করতে “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রাইভেট সেক্রেটারী অমিয় চক্রবর্তী একবার বিশাল জমিদারীর একটি ক্ষুদ্র অংশ দরিদ্র প্রজাসাধারণের জন্য দান করার প্রস্তাব করেছিলেন। ঠাকুরমশাই ইজিচেয়ারে আধাশোয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বলেছিলেন, “বল কিহে অমিয় রথীন (কবির একমাত্র পুত্রের নাম) তাহলে খাবে কী?
সূত্র:অন্নদাশঙ্কর রায়ের রচনা থেকে উদ্ধৃত পুস্তক ‘রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তাধারা: আবু জাফর
৩)অধ্যাপক অরবিন্দ পোদ্দার লিখেছে “জমিদার জমিদারই। রাজস্ব আদায় ও বৃদ্ধি, প্রজা নির্যাতন ও যথেচ্ছ আচরণের যে সব অস্ত্র,চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার জমিদার শ্রেণীর হাতে তুলে দিয়েছিল, ঠাকুর পরিবার তার সদব্যবহারে কোন দ্বিধা করেনি। এমনকি জাতীয়তাবাদী হৃদয়াবেগ ঔপনিষদিক ঋষিমন্ত্রের পুনরাবৃত্তি এবং হিন্দুমেলার উদাত্ত আহবানও জমিদার রবীন্দ্রনাথকে তার শ্রেণীস্বার্থ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।
সূত্র:অরবিন্দ পোদ্দার: রবীন্দ্রনাথ ও রাজনৈতিক প্রবন্ধ
৪) সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ও বলেছেন,
“শান্তিনিকেতনে একটি চাকরি পেয়ে তার আধা-সরকারি চাকরি ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ হলেন জমিদার মর্জির, ঠিক নেই, কখনো আবার চাকরি নষ্ট করে দিলে তার খাবার অভাব হবে। রবীন্দ্রনাথ ইন্টরালেন্ট (অসহিষ্ণু) ছিলেন।
যে মাস্টার রবীন্দ্রনাথের কথার প্রতিবাদ করতেন তার চাকরি থাকতো না।”
৫) অন্নদাশঙ্কর রায় আরও বলেছেন,
“জমিদার হিসেবে ঠাকুর পরিবার ছিল অত্যাচারী। গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল, বুট পরে প্রজাকে লাথি মেরেছেন, পায়ে ধরছেন দেবেন ঠাকুর। এটাই রেকর্ড করেছিল হরিনাথ মজুমদার। যিনি মহর্ষি বলে পরিচিত, তিনি একই রকমভাবে মানুষকে পদাঘাতে দলিত করেন। গ্রাম জ্বালাবার কথাও আছে। আবুল আহসান চৌধুরীর কাছে এর সমস্ত ডকুমেন্ট আছে।
* সমগ্র ঠাকুর পরিবার কখনো প্রজার কোন উপকার করে নাই। স্কুল করা, দীঘি কাটানো এসব কখনো করে নাই।
* মুসলমান প্রজাদের ঠিক করার জন্য নমশূদ্র প্রজা এনে বসতি স্থাপনের সাম্প্রদায়িক বুদ্ধি রবীন্দ্রনাথের মাথা থেকেই এসেছিল।
* কাঙাল হরিনাথ মজুমদার তার ‘গ্রাম্যবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকায় ঠাকুর পরিবারের প্রজাপীড়নের কথা লিখে ঠাকুর পরিবারের বিরাগভাজন হয়েছিলেন।”
সূত্র:বাংলাবাজার, ১৪.০৪.১৯৯৭ এবং ১.৫.১৯৯৭ সংখ্যা
৬) জমিদারদের বড়দেবতা হলো অর্থ আর স্বার্থ। অর্থ আর স্বার্থলাভ করতে ঠাকুর পরিবারের জমিদার হিসেবে দুর্নামের কালো দিক আড়াল করে রাখলেও প্রকৃত ইতিহাসের পাতা থেকে তা মোছা যাবে না।
ঠাকুর পরিবারের এই মহর্ষি জমিদারদের প্রতি কটাক্ষ করে হরিনাথ লিখেছেন, “ধর্মমন্দিরে ধর্মালোচনা আর বাহিরে আসিয়া মনুষ্যশরীরে পাদুকাপ্রহার, একথা আর গোপন করিতে পারি না।”
সূত্র:অশোক চট্টোপাধ্যায়: প্রাক বৃটিশ ভারতীয় সমাজ, পৃষ্ঠা ১২৭, ১৯৮৮
৭) “সিরাজগঞ্জে প্রজা নির্যাতনের দলিলও ইতিহাসে পাওয়া যায়।“এর প্রেক্ষিতে সিরাজগঞ্জের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের বদলির আদেশ হয়েছিল এবং যে যে জমিদার উপরের আবরণের গুণে তপস্বী বলিয়া গভর্নমেন্টে পরিচিত ছিলেন,তাহারা যে বিড়াল তপস্বী তা প্রমাণিত হয়েছিল। এসবের ফলশ্রুতিতে হরিনাথকে ঐ জমিদারের বিষনজনে পড়তে হয়েছিল।”
সূত্র:অশোক চট্টোপাধ্যায়, ঐ,পৃ ১২৮)
৮) কয়েক পুরুষ ধরে প্রজাদের উপর পীড়ন চালিয়েছে জোড়াসাকোর এই ঠাকুর পরিবারটি। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর ব্যতিক্রম ছিলো না। ১৮৯৪ সনে রবীন্দ্রনাথ চাষীদের খাজনা বাড়িয়ে দিয়েছিলো,খাজনা আদায়ও করেছিলো
[তথ্যসূত্র:শচীন্দ্র অধিকারি, শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ পৃঃ ১৮, ১১৭
৯) “সব জমিদাররা খাজনা আদায় করত একবার, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এলাকার কৃষকদের থেকে খাজনা আদায় করত দুইবার। একবার জমির খাজনা দ্বিতীয় বার কালী পূজার সময় চাদার নামে খাজনা।”
তথ্যসূত্র: ইতিহাসের নিরিখে রবীন্দ্র নজরুল চরিত, লেখক-সরকার শাহাবুদ্দীন আহমেদ
এই অত্যাচারী জালিম জমিদার বাংলার ইতিহাসে দরিদ্র মেহনতি মানুষের কাছে ঘৃন্যিত ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত। সাম্রাজ্যবাদী মেজাজের ধনাট্য অত্যাচারী শাসকদের বর্গ ও সংগীত প্রেমিক ইতিহাস অজান্তা মানুষের কাছেই কেবল এই ঠাকুর পূজার পাত্র হয়ে আছেন।
বিডিনিউজইউরোপটোয়েন্টিফোরডটকম/১২আগস্ট/জই