খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য কোন পথে হাঁটছেন?
প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।তিনি ফরেস্ট্রি এন্ড উড টেকনোলোজি ডিসিপ্লিনের শিক্ষক।সবার প্রত্যাশা ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন শিক্ষক উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাবেন।এই প্রত্যাশার পেছনে কারণ ছিলো নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা দূরীকরণে অনেক বেশি কার্যকরী হবেন এবং নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তাঁর একটা বাড়তি আবেগ থাকবে।সবার চাওয়া মতো এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন শিক্ষক উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।তিনি উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর অঙ্গিকার করেছেন,তাঁর আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক-শিক্ষার্থী,কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিহিংসার শিকার হবেন না।তিনি নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত রাখবেন।তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করতে চান।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ফায়েকউজ্জামানের মেয়াদকালে শিক্ষার্থীরা ৫ দফা দাবিতে আন্দোলনে নামে।খুবি প্রশাসন আন্দোলন চলাকালীন দু’জন শিক্ষকের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ এনে দু’জন শিক্ষার্থীকে ১ ও ২ বছরের জন্য বহিষ্কার করে।কিন্তু তাদেরকে বহিষ্কারের প্রক্রিয়াটি ত্রুটিপূর্ণ ছিলো।তাদেরকে বক্তব্য প্রদানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়।এই আন্দোলনে সহমত পোষণকারী ৩ জন শিক্ষককেও উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় তড়িঘড়ি করে চাকুরীচ্যুত করা হয়।বাংলা ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক আবুল ফজলকে বহিষ্কার এবং একই ডিসিপ্লিনের শাকিলা আলম ও ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিনের হৈমন্তী শুক্লা কাবেরীকে অপসারণ করা হয়।
দু’জন শিক্ষার্থী ২ দিন অবস্থান কর্মসূচি ও টানা ৭ দিন আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করে।শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অন্যায় বহিষ্কারের বিরুদ্ধে সারাদেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রতিবাদ করে।এক পর্যায়ে দু’জন শিক্ষার্থীর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করলেও ৩ জন শিক্ষকের ব্যাপারে অনড় থাকে খুবি প্রশাসন।শিক্ষকেরা আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেন। আদালত তিন শিক্ষককে চাকরি চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে স্থিতাবস্থার দিয়েছেন।কিন্তু খুবি প্রশাসন আদালতের রায় অমান্য করে (ভিন্ন ব্যাখ্যা তৈরি করে) শিক্ষকদের বেতন-ভাতা আটকে রেখেছে।
সকলেই আশা করছিলো,নতুন ভিসি বিষয়টি সমাধানে উদ্যোগী হবেন।কিন্তু, তিনি আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না বলে সমাধানের পথটি এড়িয়ে গেলেন।করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে বেতন-ভাতা ছাড়া দিন কাটানো কতটা কষ্টকর সেটা সবারই জানা।খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য বলেছেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করবেন।এভাবে শিক্ষা ও গবেষণার প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষকদেরকে আদালত চত্বরে রেখে তিনি কিভাবে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবেন সেটা যথেষ্ট সন্দেহজনক।
দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় ২০ দিন অতিবাহিত হলেও এখনো অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালু করে রিভিউ ক্লাস ও পরীক্ষা নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা শিক্ষার্থীদের সামনে হাজির করতে পারেননি।শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে শ্রেণিকক্ষের বাইরে।তাই সবারই প্রত্যাশা ছিল প্রথম কর্মদিবসেই নবনিযুক্ত উপাচার্য এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বার্তা দিবেন।
তিনি শিক্ষার্থীদের ৫ দফা দাবির বিষয়ে এখনো তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করেননি।উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় সকলে এবং সংশ্লিষ্ট নয় এমন ব্যক্তিরাও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে গেলে তাঁর দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্তরা ছাত্রবিষয়ক পরিচালকের মাধ্যম হয়ে আসতে বলেন।পরে ছাত্রবিষয়ক পরিচালকের মাধ্যম হয়ে দু’বার চেষ্টা করা হয়।ছাত্রবিষয়ক পরিচালক দু’বারই নানা অজুহাতে শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে দেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁর এই আচরণ,তাঁর উন্নয়নমূলক বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।তিনি কি সাবেক উপাচার্যের মতো শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করতে চান?শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অংশগ্রহণমূলক আলোচনা ছাড়া তাঁর ঘোষিত বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কিভাবে সম্ভব?
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ৩০ বছর পার করলেও এখনো কোনো টিএসসি নেই।এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কেমন এটা তার পরিচায়ক।
পর্যাপ্ত আবাসন ব্যবস্থা নেই।মাত্র ২২০০ জন (৩১.৫৯%) শিক্ষার্থী আবাসিক হলে থাকতে পারে যেখানে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬৯৬৫ জন (সূত্র:মানবজমিন)।নতুন উপাচার্য শিক্ষকদের জন্য নির্মাধীন ১১ তলা ভবন পরিদর্শন করে অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন।এটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ।একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আশা রাখছি, তিনি শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যা সমাধানেও দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন।শিক্ষার্থীদের আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই আবাসিক হলে একটি সিট প্রয়োজন।আবাসন ব্যাবস্থার নিশ্চয়তা পড়াশোনা ও গবেষণায় মনোযোগী হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি উদ্যোগ নিয়েছে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার।একটি নবীন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে পারলে, ৩০ বছর পূর্ণ করা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কেনো পারবে না?নতুন উপাচার্যের সদিচ্ছা থাকলে তিনিও তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করতে পারবেন যেটি তাঁর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে সহায়ক হবে।খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৯০- এ-ও উল্লেখ আছে, “আবাসস্থল:বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক ছাত্র সংবিধি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ দ্বারা নির্ধারিত স্থান ও শর্তাধীনে বসবাস করবে” (৫ম খণ্ড,দাগ নং-৪৫,পৃষ্ঠা-৬৬১৫, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আইন,১৯৯০)।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় ,শিক্ষকদের জন্য নেওয়া উদ্যোগগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন হয়।কিন্তু, শিক্ষার্থীদের বেলায় নানা তালবাহানার আশ্রয় নেওয়া হয়।এর সবচেয়ে বড় কারণ,এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় শিক্ষকেরাই যুক্ত থাকেন।শিক্ষার্থীদের কোনো অংশগ্রহণ নেই।নতুন উপাচার্য যদি তাঁর লক্ষ্য বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রত্যয়ী হন,তাহলে তিনি অবশ্যই শিক্ষার্থী-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবেন।
সাবেক উপাচার্যের আমলে দ্বিগুন হারে কয়েকবার শিক্ষার্থীদের বেতন বৃদ্ধি পায়।বেতন কমানো ৫ দফা দাবির অন্যতম।শিক্ষার্থী কর্তৃক খুবি প্রশাসনকে দেওয়া স্মারকলিপি ও ১৮ পৃষ্ঠার সংযুক্ত কপিতে দেখা যায়—’১২ ব্যাচের প্রতি সেমিস্টারে বেতন ছিলো ৭৯০ টাকা। ‘১৫ ব্যাচের বেতন প্রায় ১২৩% বৃদ্ধি পেয়ে ১৭৬৯ টাকা হয়। ’১৭ ব্যাচের প্রতি সেমিস্টারে বেতন প্রায় ৮৫ % বৃদ্ধি পেয়ে ৩৭৮৬ টাকা হয়। ’১৮ ব্যাচের বেতন প্রায় ২০% বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩৯৩৮ টাকা হয়।পরপর বেশ কয়েকবার উচ্চ হারে বেতন বৃদ্ধির কারণ কি সেটা শিক্ষার্থীদের কাছে এখনো স্পষ্ট করা হয়নি।
চিকিৎসাখাতে শিক্ষার্থীরা প্রতি সেমিস্টারে ২০০ টাকা(বছরে ৪০০ টাকা) দিলেও চিকিৎসা সেবার মান উল্লেখ করার মতো নয়।আন্দোলনের পর অস্থায়ী ভিত্তিতে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া হয়(সপ্তাহে ১ দিন) এবং মেডিকেল সেন্টারের কার্যক্রম পাশের আরডিসি হসপিটালে স্থানান্তর করা হলেও চিকিৎসাসেবার মানের যথেষ্ট উন্নতি হয়নি।খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালের সাথে একটি চুক্তি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।অথচ কর্তৃপক্ষ চাইলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের দ্রুত উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়ে ছাত্র-শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারতো।
শিক্ষার্থীরা প্রতি বছর পরিবহন ফি ১৮০০ টাকা (বছরে),প্রকাশনা ফি ৩০০ টাকা, লাইব্রেরি ফি ৪০০ টাকা, সাংস্কৃতিক ফি ৩০০ টাকা,ধর্মীয় ফি ২০০ টাকা,ছাত্রকল্যাণ ২০০ টাকা,খেলাধূলা ৩০০ টাকা,বিএনসিসি ৪০০ টাকা দেয়।কিন্তু এসব খাতেও যে পরিমাণ টাকা দেওয়া হয় সেই মানের কাছাকাছি সেবাও পাওয়া না।
একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আশা করেছিলাম,নবনিযুক্ত উপাচার্য প্রথম কর্মদিবসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকটগুলো সমাধানে স্পষ্ট বার্তা দিবেন। তিনি এখনো কোনো বার্তা দেননি এবং তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেননি। বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু মূলত শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র করেই স্থাপিত হয়,তাই একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আশা করতেই পারি শিক্ষার্থী-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো উপাচার্য মহোদয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখবেন ।
নবনিযুক্ত উপাচার্য মহোদয় “সুন্দর সুন্দর কথা” বলে বিষয়গুলো এড়িয়ে যাবেন,নাকি সমাধানের উদ্যোগ নিবেন—সেটি সময়ই বলে দিবে।
মোস্তাক আহমেদ
শিক্ষার্থী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিডিনিউজইউরোপটোয়েন্টিফোরডটকম/১৮জুন/জই