দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী দুই পরাশক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। একদিকে পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্র আর অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। সমগ্র বিশ্বে সেসময় সন্দেহ, অনিশ্চয়তা ও অনিরাপত্তার প্রভাব বাড়তে থাকে। দেশে-দেশে শুরু হয় ক্ষমতার লড়াই। ক্ষমতার এ আগ্রাসন আরও জোরদার করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে গড়ে ওঠে পশ্চিমা সামরিক সংগঠন ন্যাটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন)।
ন্যাটো সৃষ্টির আদিকথা
১৯৪৫ সালের পরপরই বিশ্ব দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এই বিভক্তির প্রারম্ভিক পদক্ষেপ ছিল সামরিক জোট সৃষ্টি করা। যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে দমানোর জন্য পশ্চিম ইউরোপকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপের দেশ ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হলেও তখন তারা ছিল অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে দূর্বল।
এরই মধ্যে ১৯৪৮ সালে শুরু হয় ‘আয়রন কারটেইল’। এটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে একধরণের শাসনব্যবস্থা। এ শাসন ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতা পুঞ্জীভূত হতে থাকে। ফলে অচিরেই ইউরোপের সঙ্গে সোভিয়েতের সম্পর্ক ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। এদিকে ইউরোপের অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত উন্নতির জন্য যুক্তরাষ্ট্র মার্শাল প্ল্যানের মাধ্যমে ব্যাপক সাহায্য সহযোগিতা প্রেরণ করতে থাকে। একই সাথে ব্রাসেলস ট্রিটির মাধ্যমে সামরিক সম্পর্ক তৈরি করে ন্যাটো প্রতিষ্ঠার মূল কাজ বেগবান হতে থাকে।
ন্যাটোর সংক্ষিপ্ত পরিচয়
মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিহত করার জন্যই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন গঠিত হয়। এটি ওয়াশিংটন ট্রিটি নামেও পরিচিত। এর সদর দপ্তর বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে অবস্থিত। সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের হাত থেকে পশ্চিম ইউরোপের দেশসমূহের স্বাধীন অখন্ডতা বজায় রাখা ছিল ন্যাটোর মূল উদ্দেশ্য। চুক্তিটির ৫ম আর্টিকেলের মূলনীতিতে বলা হয়েছে, “ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় সংগঠনটির সদস্য দেশ বা দেশসমূহের উপর অন্য কোন দেশ সামরিক হামলা করলে তা সংগঠনের সকল সদস্যের উপর হামলা বলে বিবেচিত হবে। আর যদি এধরণের হামলা হয় জাতিসংঘ চার্টারের ৫১ নং আর্টিকেল অনুযায়ী একক অথবা সংঘবদ্ধভাবে শত্রুর মোকাবেলা করা হবে। প্রয়োজনে সামরিক হামলাও চালানো হবে এবং উত্তর আটলান্টিকের দেশসমূহের নিরাপত্তা বজায় রাখা হবে।”
এদিকে ১৯৫০ সালে কোরিয়া যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো সৃষ্টির ব্যাপারে আরো সতর্ক হয়ে যায়। রাশিয়াকে থামানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র নানা পলিসি সামনে নিয়ে আসে। আর পেছন থেকে নর্থ আটলান্টিক ট্রিটিকে সংগঠনের রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে চলতে থাকে আলোচনা পর্যালোচনা। এভাবেই আস্তে আস্তে ন্যাটো একটি সংগঠনে রূপ নেয়।
বর্তমানে গোটা বিশ্বে ন্যাটো নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য কাজ করছে। এছাড়াও ইউরোপের সব দেশের জন্য সংগঠনটি উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।
ন্যাটোর উদ্দেশ্য
ন্যাটো চুক্তিটির কিছু সুনির্দিষ্ট ও মৌলিক উদ্দেশ্য আছে। যেমন—
ন্যাটো সদস্যভূক্ত দেশসমূহের অখন্ডতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে পুতিনের নেতৃত্বে ক্রিমিয়া দখল ইউরোপীয় দেশসমূহকে আবার নতুন করে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে।
ছোট দেশসমূহকে রাশিয়ার হাত থেকে রক্ষা করা। যেমন আইসল্যান্ডের মতো তিন লক্ষাধিক মানুষের ছোট দেশও ন্যাটো সদস্যভূক্ত।
যেকোন মূল্যে সমাজতন্ত্র ঠেকাতে হবে। কেননা এক দেশে সমাজতন্ত্র ছড়ালে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও সমাজতন্ত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ন্যাটো সদস্য দেশসমূহে সমস্যা দেখা দিলে তা শান্তিপূর্ণভাবে সমাধা করা।
সহযোগিতার মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ দেশসমূহের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানো।
দেশের সার্বভৌমত্ব ঠিক রেখে সকল দেশ একীভূত হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
ন্যাটোর সদস্য সমূহ
বারোটি দেশ নিয়ে সংগঠনটির যাত্রা শুরু হলেও এর বর্তমান সদস্য সংখ্যা ২৮। দিন দিন এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তুরস্কের মতো দেশও আজ ন্যাটোর সদস্য হওয়ার জন্য উদগ্রীব। ন্যাটোর প্রতিষ্ঠাকালীন ইউরোপীয় সদস্য ছিল বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, নরওয়ে। আর উত্তর আমেরিকার মধ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। এরপর ১৯৫২ সালে গ্রীস ও তুরস্ক চুক্তিতে সই করে ন্যাটোর সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৮২ সালে যুক্ত হয় স্পেন। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়। এরপর এর প্রাক্তন সদস্যরা একে একে ন্যাটোতে যোগ দিতে শুরু করে। তাদের মধ্যে সবার প্রথমে আসে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও চেক প্রজাতন্ত্র। ২০০৪ সালে এসে যোগ দেয় বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া ও স্লোভেনিয়া। ২০০৯ সালে যুক্ত হয় ক্রোয়েশিয়া ও আলবেনিয়া। ২০১৭ সালে সর্বশেষ সদস্য হিসেবে যোগ দেয় মন্টিনিগ্রো। অতি সম্প্রতি ফ্রান্স পুনরায় ন্যাটোতে যোগদান করে।
ন্যাটোর সাম্প্রতিক কার্যক্রম
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর অনেকেই ভেবেছিল হয়ত ন্যাটোর আর কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু আবার নতুন কিছু মূলনীতিকে সামনে রেখে ন্যাটোকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালে গঠিত হয় ‘নর্থ আটলান্টিক কো-অপারেশন কাউন্সিল’। এর উদ্দেশ্যও ছিল ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ১৯৯৪ সালে গঠন করা হয় মাল্টিন্যাশনাল সামরিক সংগঠন ‘পার্টনারশিপ ফর পিস’। ১৯৯৫ সালে হার্জেগোভিনায় সার্বদের বিরুদ্ধে ন্যাটোকে আক্রমণ করতে দেখা যায়। ১৯৯৯ সালে ন্যাটো সার্বিয়ায় শান্তিরক্ষী মিশন প্রেরণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক ৯/১১ হামলার পর ন্যাটোকে তৎপর হতে দেখা যায়। সর্বশেষ ২০১১ সালে গাদ্দাফির পতনেও ন্যাটোর হাত ছিল। রাশিয়াকে কেন্দ্র করে ন্যাটো আবার পুঞ্জিভূত হতে শুরু করেছে। কিন্তু ট্রাম্পের অধীনে পুতিন বিরোধী এ আন্দোলন কতটা ফলপ্রসূ হবে এখন সেটাই দেখার পালা।
লেখক- নিশাত সুলতানা
বিডিনিউজইউরোপটোয়েন্টিফোরডটকম/১৬জুন/জই