গ্রিসে ২য় লক-ডাউন
আজ ভোর ৬ ঘটিকা থেকে গ্রিসে দ্বিতীয় দফা লক-ডাউন শুরু হলো। করোনা মোকাবেলায় ইউরোপের মধ্যে যে দেশটি চমৎকারভাবে সফল হয়েছিলো, সেটি হলো গ্রিস। কিন্তু এই মুহূর্তে সারা ইউরোপে যে দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে, সেটি সবাইকে চিন্তায় ফেলেছে। গ্রিকরা হাজার বছর ধরে মহামারি চিনে। গ্রিক সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত দুটি বই – হোমারের ‘ইলিয়াদ’ আর সফোক্লিসের ‘রাজা ইডিপাস’ দুটোই শুরু হয়েছে মহামারি দিয়ে। এসব বই তারা পিচ্চিকালেই পড়ে, তারা পিচ্চিকাল থেকেই জানে – মহামারি কত খারাপ জিনিস। তাই করোনা মোকাবেলায় তারা পদক্ষেপ নিয়েছিলো একেবারে জানুয়ারি থেকেই। আর প্রথম ঢেউ সামলাতে সফলও হয়েছিল চমৎকারভাবে।
কিন্তু করোনার ২য় ঢেউ গ্রিসে ভীষণভাবে এসেছে। প্রথম কয়েক মাস মিলে যেখানে মোট আক্রান্ত ছিলো তিন হাজারের মতো, সেখানে এখন প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে দুই/তিন হাজার। তাই সরকার আবার লক-ডাউন দিয়েছে। একটি টুরিজম-প্রধান দেশের জন্য লক-ডাউন খুব কঠিন সিদ্ধান্ত। গ্রীক সরকারকে সেই কঠিনকেই ভালবেসে গ্রহণ করতে হচ্ছে ।
গ্রিসের লক-ডাউন খুব কড়া লকডাউন। বাইরে বের হবার আগে কেন যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে সেটা লিখে একটা নম্বরে SMS করে তারপর বের হতে হবে। বিনা প্রয়োজনে বাইরে ধরলে বড় জরিমানা। একটি গাড়িতে ড্রাইভারের সাথে মাত্র একজন, মানে গাড়িতে ২ জনের বেশি চলতে পারবে না। বিনা অনুমতিতে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা অফিস খুললে অনেক বড় টাকার জরিমানা। রেস্টুরেন্ট বন্ধ, শুধু হোম ডেলিভারি চালু।
সকল সরকারী অফিস বন্ধ, শুধু চালু আছে একটা ডিজিটাল গভর্নেন্স পোর্টাল। জরুরি সিদ্ধান্তের জন্য মন্ত্রীদের মোবাইলে ডিজিটাল সিগনেচার দিয়েছে। এই অনলাইন ডিজিটাল পোর্টালে তারা চিকিৎসা ব্যবস্থা যুক্ত করেছে। কে কোথায় আক্রান্ত হচ্ছে, কোথায় কি যন্ত্রপাতি আছে, সেটা ডিজিটাল উপায়ে খুব সহজেই পাওয়া যাচ্ছে। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারছে। প্রত্যেকের ট্যাক্স নম্বরের সাথে মেডিকেল সিস্টেম যুক্ত করেছে। তাই ডাক্তারের কাছে না গিয়েও ডাক্তারকে মোবাইলে জানালেই ডাক্তার অনলাইনে প্রেসক্রিপশন আপলোড করে দিতে পারছে। ডাক্তারের ফি ট্যাক্স নম্বর থেকে অটো কেটে যায়। ঔষধের দোকানে ট্যাক্স নম্বর দিলেই দোকানদার অনলাইন প্রেসক্রিপশন দেখে ঔষধ দিয়ে দিতে পারে, ঔষধের দামও ট্যাক্স নম্বর থেকে যায়। এই অনলাইন ব্যবস্থা চিকিৎসাকে দ্রুত করেছে। দ্রুত খবর পাচ্ছে, দ্রুত কোয়ারেন্টাইন হচ্ছে, প্রয়োজনে দ্রুত হাসপাতালে নিতে পারছে। গ্রিক সরকার বলছে, এই অনলাইন প্লাটফর্ম তাদের ডিজিটাল ওডিসি। মহাকবি হোমারের ওডিসিতে যেমন নায়ক ওডিসিয়াস দীর্ঘ কষ্টের পর ইথাকা দ্বীপে ফিরতে পেরেছিল, তেমনি এই ডিজিটাল পথে তারা করোনা মোকাবেলা করবে।
গ্রিসে সরকার সফল, কারণ মানুষ ঘরে থাকছে। মানুষ কেন মানছে? টানা ১০ বছর অর্থনৈতিক সংকটে তারা দেখেছে, সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি না করলে, জীবনে কী ভয়াবহ দুর্যোগ আসতে পারে। বাড়ি, গাড়ি, চাকরি সব কয়েক মাসেই নাই হয়ে যেতে পারে। তাই মানুষও বিশেষজ্ঞদের কথা মন থেকেই মানছে। গ্রিকরা অর্থোডক্স খ্রিস্টান, খুবই গোঁড়া। তবুও চার্চের পাদ্রীরা ঘোষণা দিয়ে মানুষকে চার্চে না আসতে অনুরোধ করছে। মানুষ সে কথা শুনছে।
এ বিষয়ে প্রবাসী ভাই-বোনদের সচেতনতার জন্য দূতাবাস থেকে আমরা যে নোটিশ দিয়েছি এবং অনলাইন ও ডাকযোগে কন্স্যুলার সেবার যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সেগুলো শেয়ার করলাম।
করোনা মোকাবিলায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গ্রিক মডেল প্রশংসিত হচ্ছে। তবে এই গ্রিক মডেলের সবচেয়ে বড় দিকটি মানবিকতা। এখানে কোন ডাক্তারকে বাড়ি ছেড়ে দিতে নোটিশ দেয় না তার বাড়িওয়ালা। কোন রোগীকে চিকিৎসার জন্য একের পর এক হাসপাতালে ঘুরতে হয় না। কেউ মারা গেলে তাকে কবর দিতে কেউ বাধা দেয় না। মানবতার হাত ধরে গ্রিসের নতুন ওডিসি সফল হোক, মানুষের ওডিসি সফল হোক। ওডিসিয়াসের মতোই সব বাধা দূর করে পৃথিবী
ফিরে যাক আগের দিনগুলোতে। সেই সাথে ভালো থাকুক প্রবাসী
বাংলাদেশী ভাই-বোনেরা।
সুজন দেবনাথ, লেখক ও কূটনীতিক
এথেন্স, ৭ নভেম্বর ২০২০
বিডিনিউজ ইউরোপ/৭ নভেম্বর/বার্তা সম্পাদক