কুসংস্কার একদিন শেষ হয় তবে মঙ্গলের মহিমা চির উজ্জ্বল থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশে তৎকালীন হিন্দু সমাজে বেশ কিছু কুসংস্কার ছিলো । বিভিন্ন লেখক গবেষক সমাজ সংস্কারক তাদের চেষ্টায় এগুলো বন্ধ করেন । রাজা রামমোহন রায় ,ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ইত্যাদি নামগুলো সকলের জানা । আমাদের এই পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা কখনো পূর্ব পরিকল্পিত না কোন ঘটনার কারনে এই কাজের সূচনা হয় । তবে সেই কাজটি যদি মঙ্গলময় হয় তাহলে তা যুগ যুগ ধরে চলতে থাকে । হয়তো শুরুর জৌলুস থাকে না তবে সৃষ্টির মূল আলো টুকু থাকে সারা সময় সেখানে কোন শূন্যতার সৃষ্টি হয় না । বিভিন্ন ধর্মেই অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে তার কোন যুক্তি হয় না তবে থাকে সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস । বলছি প্রায় ১৩০ বছর ধরে চলা আসস ভারতের পূর্ব বর্ধমান জমিদার ইন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের গঙ্গাটিকুরি রাজবাড়ির দুর্গাপুজার কথা । ভারতের পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রামে গঙ্গাটিকুরি গ্রামের জমিদার ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় একদিকে ছিলেন রস সাহিত্যিক ও আইনজীবী। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম হাস্যকৌতুক ও ব্যঙ্গ রচনাকার ছিলেন তিনি। ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচিত ছিলেন “পাচুঠাকুর” নামেও । ১২৮৮ বঙ্গাব্দে গঙ্গাটিকুরি গ্রামে মহল্লা কিনে জমিদারি শুরু করেন ইন্দ্রনাথ।
জমিদার বাড়িতে যৌথভাবে দুর্গাপুজো হলেও তিনি আলাদা করে শুরু করেন দুর্গা পুজো।
পুজোর ইতিহাস শুনলে অনেকটা চমকে যাবার মতো । শুরুটা হয়েছিল ১২৯৭ বঙ্গাব্দে। আগের মতো জৌলুস না থাকলেও পুজো হয় পূর্ব পুরুষের রীতি রেওয়াজ মেনে। আজও রুপোর ছাতা নিয়ে পালকি করে ঘটে জল ভরতে যান পরিবারের সদস্যরা। কথিত আছে, জমিদার ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জমিদারি মহলের কাজ শেষে গরুর গাড়ি করে উদ্ধারপুরণ থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। ফেরার পথে অন্ধকারে রাস্তায় অসহায় অবস্থায় এক গৃহবধূকে দাঁড়িয়ে থাকতেন দেখেন। সেই গৃহবধূর সঙ্গে ছিল দুই পুত্র ও দুই কন্যা সন্তান। তখন অসহায় বধূকে নিজের কাছারিতে আশ্রয় দিয়েছিলেন জমিদার ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু রাত শেষে সকালে গিয়ে দেখেন ওই পুত্র ও কন্যা সন্তান সহ গৃহবধূ কাছারিতে নেই। কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছেন। চিন্তায় পড়ে ওই গৃহবধূর খোঁজে দারোয়ানকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন জমিদার। কিন্তু তাঁর খোঁজ আর পাওয়া যায়নি। সেই রাতেই জমিদার স্বপ্নাদেশ পান। স্বপ্নে দেবী তাঁকে জানান, এই বাড়িতেই থাকতে চান দেবী মহামায়া। একবার না, বেশ কয়েকবার দেবীর স্বপ্নাদেশ পান ইন্দ্রনাথ। স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী সব নিয়ম মেনেই ১২৯৭ বঙ্গাব্দে শুরু হয় গঙ্গাটিকুরি জমিদার বাড়ির পুজো।
পুজো আসতেই শুরু হয়েছে নানা কাজ যেমন নাট মন্দিরে বেলজিয়ামের ঝাড়বাতি লাগানোর কাজ। সেই সময়ে ১০ লক্ষ ৭৩ হাজার টাকা খরচে আগ্রা থেকে মিস্ত্রি আনিয়ে বেলজিয়াম কাঁচ দিয়ে কারুকার্য করিয়েছিলেন নাট মন্দিরের দেয়ালে। অগ্রদ্বীপের কাঠের পুতুল দিয়ে সাজানো হচ্ছে নাট মন্দিরের চারপাশ। ঠাকুর দালানে জ্বলজ্বল করছে রঙিন কাচের সুক্ষ কারুকার্য। মা দুর্গার খড়ের কাঠামোয় পড়েছে মাটির প্রলেপ দিয়ে মা কে সাজানো শুরু হয় পুজোর পাঁচটা দিন বেলজিয়াম ঝাড়ের আলোয়, সানাই-এর রোশনাই ঝলমল করে উঠবে ইন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের হাতে তৈরি নাট মন্দির। এভাবে মহা ধুমধামে পূজিত হন মা দুর্গা। জমিদারি নেই, তবু আজও রস সাহিত্যিকের পৈতৃক বাড়ির পুজোয় অটুট সাবেকিয়ানা।
দুর্গা পুজোয় এই বাড়িতে আজও কয়েকশো মানুষ ভিড় জমান।। বর্তমানে ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরসূরিরা কর্মসূত্রে বাইরে থাকলেও এই জমিদার বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ও পুজো পরিচালনার জন্য ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে। এর দায়িত্বে আছেন জমিদার বাড়ির সদস্য শক্তিনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আগে এই পুজোকে কেন্দ্র করে মেলা বসতো, যাত্রাপালা হত , দারুণভাবে সাজিয়ে তোলা হত এই জমিদার বাড়ি। তবে এখন সাধারণভাবেই পুজো হয়।”এই বাড়িতে রসসাহিত্যিক ইন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের হাত ধরে শুরু হয়েছিল জগদ্ধাত্রী পুজোও। নিজস্ব নিয়ম মেনে যা চলে আসছে আজও। দুর্গাপুজোর মত জগদ্ধাত্রী পুজতেও চোখে পড়ে থিম, আলো, বিষয় ভাবনার জৌলুস। তবে এসবের মাঝেও নিজের জায়গা করে নেয় বনেদি বাড়ির পুজো গুলি। তেমনই এক ঐতিহ্যবাহী বনেদি বাড়ির পুজো হল কেতুগ্রামের গঙ্গটিকুরির বন্দোপাধ্যায় পরিবারের পুজো।শতাব্দী প্রাচীন এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে রসসাহিত্যিক ইন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের নাম। তার নামানুসারে এই বাড়ির নাম ইন্দ্রালয়। এই ইন্দ্রালয়েই প্রায় দেড়’শ বছর ধরে হয়ে আসছে জগদ্ধাত্রী আরাধনা। এই পূজাটা হয় ২ দিনের। প্রথম দিনে সপ্তমী,অষ্টমী ও নবমী পুজো হয়। দ্বিতীয় দিনে দশমীর পুজো হয়ে বিসর্জন হয়। এখানেই একটি ছোটো নদী রয়েছে, কাঁদর নামে। সেখানেই প্রতিমা বিসর্জন করা হয় রাত্রিতে। ঢাক, ঢোল বাজিয়ে বিসর্জন করা হয় দেবীকে।”সাহিত্যিক
ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম পূর্ব বর্ধমান জেলার পাণ্ডুগ্রামে, মাতুলালয়ে। আদি বাড়ি ছিল ১৭ কি.মি. দূরের গঙ্গাটিকুরি গ্রামে। পিতা বামাচরণ বিহারের পূর্ণিয়াতে ওকালতি করতেন। ইন্দ্রনাথের পড়াশোনা শুরু হয় পিতার কর্মস্থল পূর্ণিয়ার গভর্নমেন্ট স্কুলে । সেখানে স্কুলপাঠ্যে বাংলা ছিল না। তার নয় বৎসর বয়সে পিতার মৃত্যুতে তার পরিবার গঙ্গাটিকুরি এসে থাকতে শুরু করেন । তিনি ভর্তি হলেন কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীতে । এরপর বীরভূমের গভর্নমেন্ট স্কুলে পড়ার পর ভাগলপুরে গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু স্বাস্থ্য ও পারিবারিক কারণে সেখান থেকে হুগলি কলেজ হয়ে কলকাতার ক্যাথিড্রাল মিশন কলেজ থেকে বি.এ.পাশ করেন। ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্যকর্ম শুরু করেন মোটামুটি ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে । তার প্রথম ব্যঙ্গ রচনা ‘উৎকৃষ্ট কাব্যম’ । বাংলা সাহিত্যের অন্যতম হাস্যকৌতুক ও ব্যঙ্গ রচনাকার তিনি । ‘পঞ্চানন্দ’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে অক্টোবর । বিলেতি আচারের অন্ধ অনুকরণ, প্রগতি ও সংস্কৃতির নামে ইংরেজ সেবার বিরুদ্ধে তীব্র ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতেন ‘পঞ্চানন্দ’ এর মাধ্যমে। তার উল্লেখ্যযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে উৎকৃষ্ট কাব্যম’ (১৮৭০) ব্যঙ্গকাব্য, ‘কল্পতরু’
‘ক্ষুদিরাম’, ‘হাতে হাতে ফল’ ইত্যাদি। স্বপ্নে আশ্রয় চেয়েছিলেন দুর্গা’, সেই পথ পেরিয়ে আজও অমলিন গঙ্গাটিকুরির জমিদার বাড়ির পুজো। গঙ্গাটিকুরির এই জমিদার বাড়িতে দেবী দুর্গা কন্যারূপে পূজিতা। লোকবিশ্বাস এই বাড়ির দেবী দুর্গা ভীষণ জাগ্রত। মন দিয়ে ডাকলে তাঁর সাড়া পাওয়া যায়।
bdnewseu/22October/ZI/zalokati