গণমানুষের কথাসাহিত্যিক ও রাজনীতিক মোশারেফ হোসেন শাজাহান।গণমানুষের রাজনীতি, পলিমাটি নিষিক্ত কথাসাহিত্য, সাংবাদিকতার ঐকতান আর উদার বুদ্ধিদীপ্ত সাংস্কৃতিক বিস্তরণে স্বকালজয়ী অবদা নের জন্য, দেশ ও দেশের মানুষ- বিশেষ করে নদীবিধৌত ভোলার মানুষ কোনো দিন তাঁকে ভুলতে পারবে না । তিনি গণমানুষের রাজনীতিবিদ মোশারফ হোসেন শাজাহান।বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী রাজ নীতির অন্যতম রূপকার মোশারেফ হোসেন শাজাহান তার জীবদ্দশায় কখনোই ব্রাকেটবন্দী মানসিকতায় বেষ্টিত থাকেননি । শুভকাজে দেশের কাজে সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে পথ চলতে পছন্দ করতেন তিনি । তাঁর সময়ে ভোলার সাংস্কৃতিক অঙ্গন ছিল নানাবিধ প্রতিভার জৌলুশে মুখরিত । হৃদয়ের সমস্ত সুরভী দিয়েই সেকালের তরুণ সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী সাজাহান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভোলা প্রেসক্লাব । তারসময়ে ‘ব্যক্তিবিবাদ’ ‘গোষ্ঠীবিবাদ’ ভোলা প্রেসক্লাবকে গ্রাস করতে পারেনি। তিনি দল করতেন কিন্তু কখনোই দলকানা ছিলেন না ।
তাঁর স্বপ্নের দ্বীপ প্রলয়ের দ্বীপ ( when paradise becomes inferno ) যারা পড়েছেন তারা নিঃসন্দেহে স্বীকার করবেন- মোশারফ হোসেন শাজাহান একজন আন্তর্জাতিক মানের লেখক। অন্তর জাগানিয়া কথাসাহিত্যিক। শফিক রেহমান সম্পাদিত সাপ্তাহিক যায়যায়দিন এর ‘জোনাকি মন’ কলাম টি যারা নিয়মিত পড়েছেন- তারা স্বীকার করবেন মোশারফ হোসেন শাজাহান শুধু একজন কথাসাহিত্যিক নন, কথাসৃজক কথাশিল্পী। চরকলমীর সুখদুঃখে তিনি বেঁচে থাকবেন হাজার বছর । বেঁচে থাকবেন এষণায় । আপন মহিমায় । স্মৃতিকাতর যেকোনো পাঠকই কথাশিল্পের বিকাশ ও বিন্যাসে আটকে যাবেন তাঁর স্মৃতির ধূলায় পথিকে ।
প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান ভোলারত্ন মোশারেফ হোসেন শাজাহান এর জন্ম ১৯৩৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, ভোলায়। পিতা বনেদি ব্যবসায়ী মরহুম আলতাজের রহমান। মা পরলোকগত মাসুমা খানম চৌধুরাণী।
বস্তুত মোশারেফ হোসেন শাজাহানের কর্মমুখর জীবন ভোলার ভাগ্যাহত ও অশিক্ষিত মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন প্রচেষ্টায় নিবেদিত ছিল আমরণ। বন্ধুজনের ব্যানারে তাঁর জনসেবা ভোলার মানুষ যুগ যুগ মনে রাখবে। ১৯৭০ সালের ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় ও প্লাবনে ভোলার হাজার হাজার মানব সন্তান নিহত ও আহত হয় । বহু গবাদি পশু হাঁস-মুরগি সম্পদ বাড়িঘর ধ্বংস হয়। দূর্গত মানবতার ডাকে তৎক্ষণাৎ মোশারেফ হোসেন শাজাহান বন্ধু-বান্ধব ও স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে মৃতদের সৎকার, মহিলা ও শিশুদের উদ্ধারকার্য পরিচালনা করেন। অনুরূপভাবে ১৯৮৬ সালে দুর্ঘটনায় পতিত সামিয়া লঞ্চের যাত্রীদের উদ্ধার করেন, যা ছিল তাৎক্ষণিক উদ্যোগ । তাঁর এই উদ্যোগের কথা মানুষ আজও ভুলতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে জনসেবার মাধ্যমেই তিনি অস্ট্রেলিয়ার লীন রিড, শ্রীলঙ্কার আর্যরত্ন এবং নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মহিয়সী নারী মাদাম তেরেসা প্রমুখের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য পেয়েছিলেন।
১৯৮০ সালের ২৩ জানুয়ারি তিনি তাঁর সতীর্থদের নিয়ে চর শশীভূষণ থেকে এক মানবিক যাত্রা শুরু করেন। সুদীর্ঘ ১১০ মাইল যাত্রাপথে অন্তত ৫০টি জন সমাবেশে বক্তব্য রেখে মানুষকে আত্মকর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ করেন। একশ’ অনাথ শিশুকে সরকারি সাহায্য ব্যতিরেকে আশ্রয় প্রদানে সক্ষম হন। ১৯৮২ সালে বনায়ন প্রকল্প হাতে ‘নিয়ে অনাথ শিশুদের কাজের সংস্থান করেন। এতে ৬ হাজার গাছের চারা রোপন করা হয়। দরিদ্র মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য সরকারি রাস্তার উভয় পার্শ্বে বৃক্ষরোপন শুরু করেছিলেন। এতে দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি পরিবেশের উপর সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়ে । তাঁর এ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৪ এবং ১৯৯৭ সালে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত করেন।
১৯৮৩ সালে তিনি তাঁর কিছু অনুসারীসহ, শ্রীলঙ্কার পল্লী অঞ্চলে গিয়ে সেখানকার গণশিক্ষা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। দেশে ফিরে তিনি জাতীয় বন্ধুজন পরিষদ- বাংলাদেশ, গঠন করেন। এরপর শিশুস্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্র গড়ে তুলে ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত দশ সহস্রাধিক দুস্থ শিশুকে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষধ প্রদান করেন । এছাড়া ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের বিনামূল্যে খাবার স্যালাইন বিতরণ করেন ।
কৃষকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে
মোশারেফ হোসেন শাজাহান এক অকুতোভয় যোদ্ধা। এই সংগ্রামে তিনি ৬০০০ দরিদ্র কৃষককে পদযাত্রার নেতৃত্ব দেন। পুলিশ কর্তৃক নির্মমভাবে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র রুবেল হত্যার প্রতিবাদে অনশন ধর্মঘট পালন করে তিনি বিচার প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করার কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। শিবপুর,ভেলুমিয়া, ইলিশা, ভেদুরিয়া ইত্যাদি এলাকায় কোন সরকারি সাহায্য ছাড়াই কৃষি জমিতে তিনি পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে জন সাধারণকে নিয়ে সুদীর্ঘ খাল খনন করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ১৯৯৪ সালে সুদূর উত্তরবঙ্গের লালমনিরহাটে স্বাক্ষরতা অভিযানের নেতৃত্ব দেন মোশারেফ হোসেন শাজাহান।
৬ষ্ঠ সংসদে তিনি মন্ত্রী থাকাকালে ছুটি নিয়ে নিজ জেলা ভোলায় গণশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে সাড়া জাগিয়েছিলেন। যে কর্মসূচির মাধ্যমে ৪ হাজার ৬শ’ ১৬টি কেন্দ্র চালু করেন এবং সমসংখ্যক পুরুষ ও মহিলা প্রশিক্ষক নিযুক্ত করেন। ১৯৯৫ সালের ৬ ডিসেম্বর এই শিক্ষা কার্যক্রম ১ লাখ ১ হাজার ৬শ’ ৭০ জন ছাত্র-ছাত্রীকে বাংলাদেশের দৈনিক সমূহের সাংবাদিক, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে সনদপত্র প্রদানের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। এই সফল কর্মসূচির পরবর্তী এক সরকারি জরিপে এক থানার স্বাক্ষরতার হার পাওয়া যায় ৯৭%।
মোশারেফ হোসেন শাজাহান যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান অর্থ যোগানদাতা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ১. জাতীয় বন্ধুজন পরিষদ, ২. আলতাজের রহমান কলেজ, ভোলা, ৩. মাসুমা খানম উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, ভোলা; ৪. বন্ধুজন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ভোলা; ৫. দক্ষিণ চরনোয়াবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ভোলা; ৬. চরনোয়াবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয়; ৭. পশ্চিমপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়; ৮. লামসিপাতা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, দৌলতখান ইত্যাদি।
রাজনীতি ছাড়াও সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাঁর অবস্থান ঈর্ষণীয়। ছাত্রাবস্থায় তাঁর ‘নীড়-ভাঙ্গা ঝড়’ নাটক ভোলা ও বরিশাল ছাড়াও দেশের অন্যান্য স্থানে মঞ্চস্থ হয়। এ সময়ে তার ‘অনন্য ইতিহাস’ নাটকও জনপ্রিয় ছিল। ১৯৬৫ সালে তাঁর প্রথম গল্পের বই ‘ঝরা পালকের গান’ (মোস্তফা হারুণের উদ্যোগে) প্রকাশিত হয়। ‘৯০-এর পর তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা এষণা, স্মৃতির ধূলায় পথিক, ভাগ্যবান, চর কলমীর সুখ-দুঃখ, স্বপ্নের দ্বীপ প্রলয়ের দ্বীপ (এটি ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছিল), টিভিতে তাঁর নাটক ‘অকস্মাৎ’ (১৯৬৮), ‘সমান্তরাল’ (১৯৯২) ও ‘বহতা এষণা’ (১৯৯৩) খুবই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাঁর ‘চর কলমীর সুখ-দুঃখ’ উপন্যাস নিয়ে একুশে টেলিভিশনে সিরিজ নাটক হয়েছে। লন্ডনের পেঙ্গুইন থেকে তাঁর একটি গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ‘জোনাকী মন’ তাঁর সর্বশেষ প্রকাশনা। জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকার তিনি একজন জনপ্রিয় কলামিষ্ট ছিলেন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি ৬ বার নির্বাচিত এমপি। ১৯৮০ সালে উপমন্ত্রী, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ছিলেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে তিনি বেশ কয়েকবার ফ্রান্স, চীন, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশ সফর করেন। যায়যায় দিন-এ প্রকাশিত তাঁর কলাম ‘জোনাকী মন’ খুবই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সর্বশেষ তিনি বিগত ১ল অক্টোবর ২০০১-এ অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হন এবং সরকার প্রতিষ্ঠার পর তিনি ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বহুমাত্রিক প্রতিভাবান রাজনীতিবিদ ও সাহিত্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মোশারফ হোসেন শাজাহান ৫ মে ২০১২ সালে ইউনাইটেড হাসপাতালে ঢাকায় ইন্তেকাল করেন । দেশ ও দেশের মানুষ কোনো দিন ভূলবেনা তাঁকে।
bdnewseu/21August/ZI/bhola