আজ শনিবার হজের প্রধান পর্ব আরাফাত দিবস।
আরা ফাতের দিন বা আরাফার দিন ইসলাম ধর্মের
একটি পবিত্র দিন যেটি এই ধর্মের পরিপূর্ণতা লাভেরদিবস হিসেবে পরিচিত। এই দিনটি ইসলামিক চন্দ্র পঞ্জিকা অনুসারে জিলহজ মাসের ৯ তারিখে সংগঠিত হয়, যা রমজান মাস শেষ হওয়ার প্রায় ৭০ দিন পর ঘটে। এই দিনটির শেষ ভাগে, মুসলিম হজ্জ্ব যাত্রীরা মিনা থেকে যাত্রা করে নিকটবর্তী পাহাড়ের সন্নিকটবর্তী-সমভূমি আরাফাতের ভূমিতে এসে উপস্থিত হন এবং সারাদিন ইবাদত বন্দেগিতে অতিবাহিত করবেন। এই আরাফাতের ময়দানের এই দিনটিতেই নবী মুহাম্মদ (স.) তাঁর জীবনের শেষ বছর বিদায় ভাষন দিয়েছিলেন।
আরাফার দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য:
জিলহজ মাসের ৯ তারিখ সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাহ ময়দানে চিহ্নিত সীমানার মধ্যে অবস্থান করা হজ এর প্রধান রুকন বা ইয়াওমে আরাফা অর্থাৎ হাজীদের আরাফার ময়দানে অবস্থানের দিন। এই দিনকেই আরাফার দিন বলা হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলমানরা এ দিন আরাফাতের ময়দানে সমবেত হন। আরাফার দিনের ফজিলত ও তাৎপর্য অপরিসীম। এ দিনটিকে ইসলাম ধর্মে বছরের শ্রেষ্ঠ দিন হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
মুসলমানদের জন্য আরাফার দিন আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত এবং গুনাহ থেকে পরিত্রাণের দিন হিসাবে ঘোষণ দেয়া হয়েছে।
আরাফা শব্দের অর্থ:
আরাফাত শব্দটি একটি আরবি শব্দ। ‘আরাফাহ’ শব্দের অর্থ হলো চেনা, জানা, পরিচয় লাভ করা, অবহিত হওয়া, স্বীকার করা, স্বীকৃতি দান করা ইত্যাদি।
ইসলাম ধর্মের তথ্য অনুসারে প্রথম মানব হজরত আদম (আ.) এবং তাঁর স্ত্রী হজরত হাওয়া (আ.)
বেহেশত থেকে পৃথিবীতে আগমনের সময় দুজন পৃথক দুই স্থানে অবতরণ করেছিলেন। দীর্ঘদিন পর এই দিনে আরাফার পাহাড়ের কাছে তাদের পরস্পরের পরিচয় হয়। এ থেকেই ‘আরাফা’ শব্দের উৎপত্তি।
আরাফা ময়দানের অবস্থান:
সৌদি আরবের মক্কা নগরী থেকে ১৫ মাইল পূর্বে তাইফের পথে অবস্থিত এক মরু ময়দানের নাম ‘আরাফাত’। আরাফাতের ময়দান পবিত্র মক্কা নগরী পূর্বে জাবালে রহমতের পাদদেশে হেরেমের সীমানার বাইরে অবস্থিত। তা দৈর্ঘ্যে দুই কিলোমিটার এবং প্রস্থেও দুই কিলোমিটার। তা তিন দিক দিয়ে পাহাড়বেষ্টিত। এর দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে রয়েছে মক্কা হাদাহ তায়েফ রিং রোড। এ সড়কের দক্ষিণ পাশে আবেদি উপত্যকায় রয়েছে মক্কা নগরীর সুপ্রসিদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়।
তার উত্তরে রয়েছে সাদ পাহাড়।বছরের অধিকাংশ সময় এই স্থানে লোক সমাগম হয় না। জিলহজ মাসের ৯ তারিখ হজের দিন হজযাত্রীরা মিনা থেকে এখানে উপস্থিত হন। আরাফাতে অবস্থান হজের অন্যতম ফরয এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এসময় এখানে খুতবা পড়া হয় এবং যোহর ও আসরের নামাজ একত্রে পড়া হয়। সন্ধ্যায় হজযাত্রীরা আরাফাত ছেড়ে মুজদালিফার উদ্দেশ্যে রওনা হন।
আরাফা দিবসের মর্যাদা:
আরাফাহ দিবস হল এক মর্যাদাসম্পন্ন দিন। এ দিনটি অন্যান্য অনেক ফজিলত সম্পন্ন দিনের চেয়ে বেশি মর্যাদার অধিকারী। এই দিনটি হজ আদায়ের জন্য যারা আরাফার ময়দানে যারা উপস্থিত হয়েছেন এবং যারা উপস্থিত হননি-সকল মুসলিমদের জন্যই একটি মর্যাদাপূর্ণ দিন। কারণ এই দিনে বিশ্বমুসলিমের প্রতি
মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা’য়ালা তার নিয়ামত ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণ ঘোষণা করেন।
মহান আল্লাহ বলেন,
اَلْيَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَاَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الْاِسْلَامَ دِيْنًاۗ فَمَنِ اضْطُرَّ فِيْ مَخْمَصَةٍ غَيْرَ مُتَجَانِفٍ لِّاِثْمٍۙ فَاِنَّ اللّٰهَ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ ( المائدة: ٣ )
“আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম।”
– সূরা আল মায়িদা,আয়াত: ৩
ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায়,ইসলাম ধর্মের
খলিফা হযরত ওমর (রা.) এর শাসনামলে একবার
ইহুদী ধর্মের কয়েকজন হযরত উমর (রা.) কে বললো যে, আপনারা এমন একটি আয়াত তিলাওয়াত করে থাকেন যে, যদি সেই আয়াতটি আমাদের উপর নাযিল হতো তাহলে আমরা সেই দিনটিকে ঈদ হিসেবে উদযাপন করতাম।
তখন হযরত উমর রা. এ কথা শুনে বললেন, আমি জানি কখন তা অবতীর্ণ হয়েছে, কোথায় তা অবতীর্ণ হয়েছে, আর অবতীর্ণ হওয়ার সময় আল্লাহর নবীও রাসূল (সা.) কোথায় ছিলেন। হ্যা, সেই দিনটি হল আরাফার দিবস। আল্লাহর শপথ! আমরা সেদিন আরাফার ময়দানে ছিলাম। আর আয়াতটি হলো, “আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম”।
– সহিহ বুখারী: ৪৬০৬
আরাফার দিন অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ দিন:
আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদেরকে গোনাহমুক্ত হওয়ার জন্য যে সমস্ত দিবস দান করেছেন, সে সমস্ত দিনগুলোর মধ্যে ইয়াওমে আরাফা অন্যতম একটি দিন। আরাফাত দিবস অত্যন্ত মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ একটি দিন। আল্লাহতায়ালা বলেন,
وَ شَاهِدٍ وَّ مَشۡهُوۡدٍ ؕ۳ আর কসম সাক্ষ্যদাতার এবং যার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেওয়া হবে তার। (সুরা বুরুজ : ৩)। ওই আয়াতে এই দিনকে مَشْهُود (মাশহুদ) বলা হয়েছে এবং এর কসম খাওয়া হয়েছে। প্রিয় নবীজি (সা.) مَشْهُود (মাশহুদ) কে আরাফাতের দিন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন (তিরমিজি)।
আরাফার দিনটি ইসলামে এত মর্যাদাপূর্ণ যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এটাকে ঈদের দিন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হযরত উকবাহ বিন আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আরাফাতের দিন, কোরবানির দিন এবং তাশরিকের দিনগুলো হচ্ছে ইসলামে আমাদের ঈদের দিন। এ দিনগুলো হচ্ছে পানাহারের দিন। (সুনান আবু দাউদ : ২৪২১)।
আরাফার ময়দান ক্ষমা পাওয়ার ময়দান হিসেবেও পরিচিত। শূন্য মস্তকে সেলাইবিহীন বস্ত্র পরিহিত লাখো লাখো আল্লাহ প্রেমিকের কান্নার আওয়াজ এদিন আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে। লাব্বাইকা, লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক- ‘হে প্রভু! বান্দা হাজির, বান্দা হাজির’ বলে আল্লাহর ঘরে
হাজিরাদানকারী আল্লাহপ্রেমিকরা এদিন আরাফাতের ময়দানে সমবেত হয়ে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে রাববুল আলামিনের দরবারে কাতর হয়ে ফরিয়াদ জানান।
উল্লেখ্য যে,দশম হিজরি সনে এই আরাফাতের ময়দানে নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) হজ উপলক্ষে তাঁর শেষ ভাষণ দিয়েছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে যা বিদায় হজের ভাষণ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
আরাফা দিবসের রোজা দু বছরের কাফ্ফারা:
সাহাবী আবু কাতাদাহ রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে আরাফাহ দিবসের সওম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ইহা বিগত ও আগত বছরের গুনাহের কাফ্ফারা হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
– সহিহ মুসলিমঃ ১১৬৩
আরাফার দিন জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের দিন:
হজ আদায়ে যারা মক্কায় অবস্থিত তারা মীনা থেকে এসে আরাফাতের সীমায় অবস্থান করে। ৯ই জিলহজ সূর্যোদয়ের পর হাজীগন মীনা হতে আরাফার দিকে রওয়ানা দেন এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত নামীরা নামক ময়দানে অবস্থান করাটা সুন্নাত, যদি তা সহজসাধ্য হয়। যেখানেই অবস্থান করুক সকলেই কিবলামুখী হয়ে বসেন। সম্ভব হলে জাবালে রাহমাত নামক পর্বতকে সামনে রেখে কিবলামুখী হয়ে বসে থাকেন।
ইসলাম ধর্মের তথ্য অনুসারে এই দিনে মহান আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের জন্য তাঁর অনুগ্রহের দ্বার খুলে দেন। ফেরেশতাদের নিকট বান্দাদের আনুগত্য ও নিজের গৌরব প্রকাশ করেন। এই দিনে বেশি সংখ্যক লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করেন। তাই এই স্থানে উপস্থিত
মুসলিমরা সারাদিন আল্লাহ তা’আলার যিকর,দুই
হাত তুলে নিজের জন্য, পিতা-মাতা, পুত্র কন্যা, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব সবার জন্য দোয়া
করেন।
এই আরাফাতে অবস্থানই হজের মূল কাজ। রাসূল (সা.) বলেছেন-আমি এবং নবীগণ কর্তৃক উচ্চারিত শ্রেষ্ঠতম কথা হচ্ছে: লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ইউহয়ী ওয়া ইয়ূমীতু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর। সহিহ আল বুখারী, মুসলিম
এই দু’আটি বেশি বেশি পড়া সুন্নাত, এর অর্থ হলো-
“আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই। সমস্ত রাজত্ব একমাত্র তাঁরই অধিকারভুক্ত। সমস্ত প্রশংসা একমাত্র তাঁর প্রাপ্য। তিনিই জীবিত করেন, তিনি মৃত্যু প্রদান করেন। আর তিনি সব বস্তুর উপর সর্বশক্তিমান।“
নবী পত্নী হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আরাফার দিন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার বান্দাদের এত অধিক সংখ্যক জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন যা অন্য দিনে দেন না। তিনি এ দিনে বান্দাদের নিকটবর্তী হন ও তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন, তোমরা কি বলতে পার আমার এ বান্দাগণ আমার কাছে কি চায় ?- সহিহ মুসলিম-১৩৪৮
bdnewseu/15June/ZI/Hajj