পদ্মা সেতু ঘিরে স্বপ্নের দূরত্ব মাত্র ১৫০ মিটার। ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের উপর শেষ স্প্যানটি বসলেই স্বপ্ন স্পর্শ করবে বাংলাদেশ। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্ত এক সুতোয় গেঁথে দৃষ্টি সীমায় পূর্ণ রূপে ভেসে উঠবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো।
আজ বৃহস্পতিবার ৪১ নম্বর স্প্যানটি বসাতে প্রস্তুত প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এদিন সবকিছু ঠিক থাকলে লেখা হবে নতুন ইতিহাস। চ্যালেঞ্জ জয়ের অদম্য স্পৃহাই যে হাতের মুঠোয় সাফল্য এনে দিয়েছে তারও প্রমাণ মিলবে।
তবে এজন্য বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আসতে হয়েছে। বিশ্ব দেখছে নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষম বাংলাদেশ।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যুগান্তরকে বলেন, আমাদের স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী সিদ্ধান্তের ফসল এ সেতু।
বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপের ফলে দেশীয় অর্থায়নে এ সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি আমাদের সক্ষমতার প্রতীক।
জানা গেছে, স্প্যানগুলোর উপর সড়ক ও ট্রেন লাইন (স্ল্যাব) বসানোর কাজও এগিয়ে চলছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও করোনার মধ্যেও ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মূল সেতুর বাস্তব কাজ শেষ হয়েছে ৯১ শতাংশ।
সার্বিকভাবে প্রকল্পের অগ্রগতি ৮২ দশমিক ৫০ শতাংশ। বাকি অংশ নির্মাণ কাজ ২০২১ সালের মধ্যে শেষ করার সময়সীমা রয়েছে।
যদিও মহামারীর প্রভাবসহ নানা কারণে ওই সময়ের মধ্যে সেতু নির্মাণ কাজ শেষ করা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সেক্ষেত্রে ২০২২ সালের মার্চে গাড়ি চলাচল শুরুর জন্য খুলে দেয়ার পরিকল্পনা আছে সেতু কর্তৃপক্ষের।
নির্মাণ শেষে পদ্মা সেতু জিডিপিতে ১ দশমিক ২৬ শতাংশ অবদান রাখবে বলে আশা করছেন সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন।
তিনি যুগান্তরকে বলেন, শেষ স্প্যানটি বসলে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারই দৃশ্যমান হবে। বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে আমাদের সক্ষমতা প্রমাণ হবে।
সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুতে ৪২টি পিলার ও ৪১টি স্প্যান যুক্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৪২টি পিলার ও ৪০টি স্প্যান বসানোর কাজ শেষ। বাকি একটি স্প্যান।
বাকি এ ৪১তম স্প্যান আজ ১০ ডিসেম্বর বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছে। এটি বসলেই মূল কাঠামোর কাজ শেষ হবে।
এরপর কাঠামোর উপর বসবে অন্যান্য স্থাপনা। এ বিষয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ১৫ ডিসেম্বরের আগেই শেষ স্প্যানটি বসানোর পরিকল্পনা আছে।
সব ঠিক থাকলে এ সময়ের মধ্যে স্প্যানটি বসবে। তবে সম্প্রতি কুয়াশার প্রকোপ বেড়েছে। সেটিও বিবেচনায় আছে। কবে নাগাদ সেতুর কাজ শেষ হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ২০২১ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে আমাদের দেশি ও বিদেশি কর্মী, কনসালট্যান্ট ও প্রকৌশলীদের সঠিকভাবে কাজে নামানো সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে এখনই কাজ শেষ হওয়ার টাইম ফ্রেম বলা যাচ্ছে না।
পদ্মা সেতু সংশ্লিষ্ট এক প্রকৌশলী জানান, সেতুর বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পিলার ও স্প্যান বসানোর কাজ। এ দুটি কাজের সিংহভাগই নদীর ভেতরে করতে হয়। স্রোত, কুয়াশা, বন্যা এ কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে আসছে।
শেষ স্প্যানটি বসলে বাকি কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে যেসব স্প্যান বসেছে সেগুলোর উপরের কাঠামো বসানোর কাজ চলছে।
সম্প্রতি সরেজমিন দেখা গেছে, দোতলা আকৃতির পদ্মা সেতুতে একই সঙ্গে ট্রেন ও গাড়ি চলাচলের লক্ষ্যে প্রস্তুত করা হচ্ছে। রেল ও গাড়ি চলাচলের রাস্তা নির্মাণের অংশ হিসেবে পৃথকভাবে স্ল্যাব বসানোর কাজ জোরগতিতে এগিয়ে চলছে।
দোতলা আকৃতির সেতুর নিচের অংশে রেলওয়ে স্ল্যাব ও উপরের অংশে রোডওয়ে স্ল্যাব বসানো হচ্ছে। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্ল্যাবের মধ্যে ১ হাজার ২৬১টি বসানো হয়েছে; যা শতকরা ৪৩ দশমিক ২৩ শতাংশ।
এ স্লাবের উপর পিচঢালা রাস্তা নির্মাণ করা হবে। একই সময়ে সেতুর নিচের অংশে ২ হাজার ৯৫৯টি স্ল্যাবের মধ্যে ১ হাজার ৮৬৮টি স্থাপন করা হয়েছে, যা শতকরা ৬৩ দশমিক ১৩ শতাংশ।
এর উপর ট্রেন লাইন বসানো হবে। মাওয়া ও জাজিরা ভায়াডাক্টে ৪৮৪টি সুপারটি গার্ডারের মধ্যে ৩০৩টি স্থাপন করা হয়েছে। তবে পদ্মা সেতুর তুলনায় নদীশাসনের কাজ কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে।
সাম্প্রতিক নদী ভাঙনে আরও জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবুও ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত নদীশাসনের কাজ এগিয়েছে ৭৫ দশমিক ৫০ শতাশ। মাওয়া ও জাজিরা সংযোগ সড়ক নির্মাণ আগেই শেষ হয়েছে।
জানা গেছে, মূল পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এটি নির্মাণ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি।
নভেম্বর পর্যন্ত সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৭২৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এ হিসাবে আর্থিক অগ্রগতি ৮৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। যদিও সেতু নির্মাণে বাস্তব অগ্রগতি ৯১ শতাংশ।
অপরদিকে নদীশাসনের কাজ করছে চীনের সাইনোহাইড্রো কর্পোরেশন লিমিটেড। নদীশাসন কাজে ৮ হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকার মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ৫ হাজার ৬৭৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
মূল সেতু, নদীশাসন, সড়ক নির্মাণসহ সব মিলিয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ব্যয় ধরা আছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। নভেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৪ হাজার ১১৫ কোটি ২ লাখ টাকা।
অর্থনীতিবিদ ও পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের সড়ক যোগাযোগ খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। খুলনা ও বরিশাল বিভাগসহ দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন হবে।
এ সেতু ঘিরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তৃত হচ্ছে, বাড়ছে বিনিয়োগ। ইতোমধ্যে এসব জেলায় নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠছে। সেগুলোতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
এছাড়া কৃষক সরাসরি উপকৃত হবেন। তাদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে পাঠাতে পারবেন। সার্বিকভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার হবে।
বিশেষ করে মোংলা ও পায়রাবন্দর ব্যবহার বাড়বে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমে আসবে। সব মিলিয়ে এটি বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরি বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের অনেক দ্বার খুলবে।
ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ আরও সহজ হবে। দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়নের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। ওই সময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও সচল হবে। যা জাতীয় অর্থনীতিতে যুক্ত হবে।
সেতু নির্মাণে সময় ও ব্যয় বেড়েছে বারবার : জানা গেছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ও বাস্তবায়নের সময় দফায় দফায় বেড়েছে। ২০০৭ সালে একনেকে ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়।
পরে নকশা পরিবর্তন হয়ে দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ায় ব্যয়ও বৃদ্ধি পায়। ২০১১ সালে প্রথম প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। এরপর আবারও বাড়িয়ে প্রকল্পের বর্তমান ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।
অপরদিকে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার সময়ও বারবার পিছিয়েছে। নকশা প্রণয়নের পর ২০১৩ সালে সেতু চালুর কথা ছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের জটিলতায় ওই সময়ে কাজই শুরু করা যায়নি।
২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করে চায়না রেলওয়ে ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। ৪৮ মাসে এ সেতু নির্মাণে চুক্তি করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বর এটি শেষ হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু তিন দফায় ৩১ মাস পিছিয়ে ২০২১ সালের ৩০ জুন নির্ধারিত রয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর উদ্বোধনের লক্ষ্য ধরা হয়।
করোনার প্রভাব ও সাম্প্রতিক বন্যাসহ নানা কারণ দেখিয়ে ২০২২ সালের ২৩ এপ্রিল পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করার কথা জানিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
বিশ্বব্যাংকের আপত্তি আটকাতে পারেনি পদ্মা সেতু : বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আটকাতে পারেনি পদ্মা সেতু নির্মাণ। নিজস্ব অর্থায়নেই এখন নির্মাণ হচ্ছে পদ্মা সেতু।
যদিও ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ সহায়তা অনুমোদন করে। ওই বছরের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি সই হয়।
একই বছর ১৮ মে জাইকার সঙ্গে, ২৪ মে আইডিবির সঙ্গে এবং ৬ জুন এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি সই হয়। ওই বছরের সেপ্টম্বরে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক।
এতে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন ও তার মালিকানাধীন কোম্পানি সাকোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ করা হয়।
ওই অভিযোগের পর একপর্যায়ে প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামকে অপসারণ করা হয়। সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে বদলি করা হয়।
অনুসন্ধান দল গঠন করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবুও দুর্নীতির বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ না নেয়ার অভিযোগ তুলে ২০১২ সালের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের ঋণ সহায়তা স্থগিতের ঘোষণা আসে।
এরপর সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করে।
সূত্র- যুগান্তর পত্রিকার অনলাইন
বিডিনিউজ ইউরোপ /১০ ডিসেম্বর / জই