বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয় যুক্তরাষ্ট্র
‘ভারত বর্জন’ প্রসঙ্গে ম্যাথিউ মিলার।যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, “আমরা বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ককে মূল্য দিই।সোমবার (১১ মার্চ) রাজধানী ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশে তথাকথিত ‘ভারত বর্জন’ প্রচারণা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, “একটি মুক্ত, উন্মুক্ত, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিশ্চিত করাসহ আমাদের অভিন্ন স্বার্থ অনুসরণ করতে উভয় দেশের সরকারের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাব আমরা।”
উপস্থিত সাংবাদিকদের থেকে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়—গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এ অঞ্চলে ‘ভারত বর্জন’ প্রচারণার প্রচার হচ্ছে। বাংলাদেশে একতরফা নির্বাচনের পর দেশটির জনগণ প্রতিবেশী দেশের তৈরি পণ্য বর্জনের বিষয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। আপনি এ বিষয়কে কীভাবে নিচ্ছেন?
জবাবে ম্যাথিউ মিলার বলেন, “এ প্রচারণা সম্পর্কে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। বাংলাদেশ বা বিশ্বের যেকোনো দেশই হোক না কেন, ভোক্তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি অবশ্যই কোনো মন্তব্য করব না। তবে বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে আমরা গুরুত্ব দিই। একটি স্বাধীন, উন্মুক্ত, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ ভারত-মহাসাগরীয় অঞ্চল নিশ্চিত করাসহ আমাদের অভিন্ন স্বার্থগুলো রক্ষায় দুই দেশের সরকারের সঙ্গেই কাজ চালিয়ে যাব আমরা।”
বাংলাদেশে ভারত বিরোধী প্রচারণা:
সম্প্রতি বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ইন্ডিয়া আউট’ নামে ভারত বিরোধী এক ধরনের প্রচারণা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশ ভারতের পণ্যসহ দেশটিকে ‘বয়কট’ নিয়ে করা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রচারণা চলছে।
এই প্রচারণায় লক্ষ্য করা গেছে ফেসবুক, এক্স ও ইউটিউবে। যারা এসব প্রচারণা চালাচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কিংবা সরকার-বিরোধী হিসেবে পরিচিত। এর সঙ্গে ছোটখাটো কয়েকটি রাজনৈতিক দলও রয়েছে।
সম্প্রতি ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ঢাকার অলি-গলিতে এক তরুণ হ্যান্ডমাইক হাতে ভারতের পণ্য বর্জনের প্রচারণা চালাচ্ছেন। বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এসব প্রচারণা ভারতেও অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। বাংলাদেশের এসব প্রচারণার বিরুদ্ধে ভারতের অনেকে ইউটিউবে পাল্টা জবাব দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে কিছুদিন আগে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের কাছেও প্রশ্ন রাখা হয়েছিল।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রসঙ্গ:
সংবাদ সম্মেলনে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও পিটার হাসের বিষয়েও এক প্রশ্নের জবাব দেন ম্যাথিউ মিলার। এক সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেন, রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে মন্তব্য করেছেন। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী।
তাঁর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। আপনি জানেন, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিকভাবে ড. ইউনূসকে হয়রানি করছে। কর্তৃপক্ষের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সমালোচনা বাড়ছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
জবাবে ম্যাথিউ মিলার বলেন, “আপনারা এর আগেও মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলাগুলো নিয়ে আমার কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উদ্বেগের কথা শুনেছেন, যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের আইনের অপব্যবহার করে ড. ইউনূসকে হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখানো হতে পারে। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস তাঁর ক্ষমতার ভিত্তিতে দায়িত্ব পালন করেন।”
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা এবং আপিল:
এ বছরের ১ জানুয়ারি ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে একটি ধারায় ছয় মাসের কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করে রায় দেয় ঢাকার একটি শ্রম আদালত। আরেকটি ধারায়, তাদের ২৫ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এই মামলা দায়ের করেছিল কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। দণ্ডাদেশ ঘোষণার পর, ড. ইউনুসের আইনজীবীরা জামিন আবেদন করেন। আদালত আবেদন মঞ্জুর করলে কারাগারে যেতে হয়নি ড. ইউনূসকে।
রায়ের পর প্রতিক্রিয়ায় আদালতে সাংবাদিকদের ড. ইউনূস বলেছিলেন, “যে অপরাধ করিনি, সেই অপরাধর জন্য শাস্তি পেলাম।” এই মামলা ছাড়াও, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে, দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলাও রয়েছে। এই মামলাকে হয়রানিমূলক বলে উল্লেখ করেন ড. ইউনূসের পক্ষের আইনজীবীরা।
এদিকে শ্রম আদালতের দেওয়া ৬ মাসের কারাদণ্ডের রায় চ্যালেঞ্জ করে, ২৮ জানুয়ারি (রবিবার) শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস ।
বিস্তারিত শুনানির জন্য আদালত আপিল গ্রহণ করে এবং আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেয়।
ড. ইউনূসের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, “প্রাথমিক শুনানির পর, শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল আপিল আবেদনটি শুনানির জন্য গ্রহণ করেছে এবং এ মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রম আদালতের নথি তলব করেছে।”
মামলার বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বক্তব্য:
এদিকে বাংলাদেশের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকার মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে না। ১ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) সচিবালয়ে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান।
আনিসুল হক বলেন, “ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হয়রানি করার জন্য সরকার কিছু করছে না। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে না। যে মামলা হয়েছে, সেটা শ্রমিকেরা করেছিল, তারপর শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিদপ্তর তাঁর বিরুদ্ধে একটা মামলা করেছে। আমি কেবল বলব, দেশ আমাদের সবার। নির্বাহী, আইনসভা কিংবা বিচার বিভাগ সব বিষয়ে দেশের অর্জনই দেশের মানুষের।”
আনিসুল হক আরও বলেন, “অকাট্য প্রমাণ থাকার পরও বিদেশে ছড়ানো হচ্ছে- তাঁর (ড. ইউনূস) বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মিথ্যা। আরও বলা হচ্ছে আমরা তাঁকে হয়রানির জন্য এটা করছি।” এ ছাড়া, সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলার বিচার অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে চলছে।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের বিচার বিভাগ অত্যন্ত স্বচ্ছ। অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচার চলছে।” তিনি আরও বলেন, “তাঁর জামিন পাওয়ার বিষয়টিই প্রমাণ করে বিচার অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে চলছে।”
হাছান মাহমুদ বলেন, ড. ইউনূসের সংগঠনের বঞ্চিত কর্মীরা তাঁর বিরুদ্ধে মামলাগুলো দায়ের করেছে, সরকার এতে কোনো পক্ষ নয়।
তথ্যসূত্র: ভয়েস অফ আমেরিকা
bdnewseu/14March/ZI/USA