পাওয়া গেল টাইটানের ধ্বংসাবশেষ, বেঁচে নেই কেউ
উত্তর আটলান্টিকে নিখোঁজ হওয়া মিনি-সাবমেরিন “টাইটান”- বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হয়েছে। বিস্ফোরণের পর ৫ জন যাত্রীর ততক্ষণাৎ মৃত্যু হয়েছে।শুক্রবার (২৩ জুন) টাইটান মিনি সাবমেরিনের প্রতিষ্ঠান ওশানগেটের তরফেও এ বিষয়ে এক বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘আমাদের সিইও স্টকটন রাশ, শাহজাদা দাউদ, তাঁর ছেলে সুলেমান দাউদ, হামিশ হার্ডিং, পল নারজিওলেটকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন! তাঁরা দুঃসাহসিক অভিযাত্রী ছিলেন, যাঁরা গভীর সমুদ্রে পৌঁছেছিলেন অ্যাডভেঞ্চারের হাত ধরে। এই কঠিন সময়ে তাঁদের পরিবারের সাথে সমব্যথী আমরা।’এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোস্টগার্ড এক বিবৃতিতে জানিয়েছে ১৯১২ সালে আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে যাওয়া টাইটানিক জাহাজকে দেখতে আসা ৫ জন যাত্রী নিয়ে মিনি সাবমেরিন টাইটান আটলান্টিক মহাসাগরের তলে টাইটানিকের পাশেই বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হয়েছে। ফলে “টাইটান” ডুবো জাহাজে থাকা পাঁচজন যাত্রীই মারা গেছে। অক্সিজেন ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে নয়, বরং ডুবোজাহাজটি বিস্ফোরিত হওয়ার কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে।
১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল প্রথম যাত্রাতেই এক হিমশৈলের সাথে বাড়ি খেয়ে বৃটিশ জাহাজ টাইটানিক ডুবে গিয়েছিল। ডুবে যাওয়ার জায়গাটা কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ডের তীর থেকে ৬৯০ কিলোমিটার দূরে, আটলান্টিক মহাসাগরের সাড়ে বারো হাজার ফুট বা ৩.৮১ কিলোমিটার নিচে। ১৯৮৫ সালে প্রথমবার টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করা হয়। টাইটানিক জাহাজটি যে দুটো টুকরো হয়ে গিয়েছিল সেটা মোটামুটি সবারই জানা; টুকরো দুটো একে অন্যের থেকে ২০০০ ফুট দূরে পড়ে আছে। আর এই দু’ টুকরো দেখার জন্যই এত আয়োজন।
এই প্রাইভেট ট্যুরের আয়োজন করে থাকে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক সাবমেরিন কোম্পানি ওশানগেইট ইনকরপোরেটেড (ওশানগেইট এক্সপেডিশন্স)। তবে ২০০৯ থেকে নয়, ২০২১ সাল থেকে টাইটানিক দর্শন প্যাকেজ অফার করা শুরু করে ওশানগেইট। উদ্দেশ্য ছিল, স্পেসএক্স বা ব্লু অরিজিন যেমন বড়লোকদের মহাকাশে নিয়ে যাওয়ার প্যাকেজ দেয়, তেমন করে ওশানগেইট সাগরতলে নিয়ে যাবে।
প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও স্টকটন রাশ ২০১৭ সালে বলেছিলেন যে, গত ৩৫ বছরে সিরিয়াস কোনো অঘটন ঘটেনি সাবমেরিন দুনিয়ায়; সেই হিসেবে, পরিসংখ্যানগতভাবে, সাবমেরিন হলো দুনিয়ার নিরাপদতম যান। তাছাড়া, তার মতে, মঙ্গল বা অন্য গ্রহ নয়, মানবজাতির বাসযোগ্য ভবিষ্যৎ সমুদ্রের নিচেই হওয়া উচিৎ।
টাইটানকে সাবমেরিন লিখলেও আসলে এটি হবে সাবমার্সিবল (Submersible), ডুবোযান। সাবমার্সিবল এমন জলযান যেটি কিনা পানির নিচে চলে, কিন্তু আশপাশে সাপোর্ট হিসেবে থাকে কোনো সার্ফেস জলযান অর্থাৎ যা পানির ওপর থাকে, কিংবা সাপোর্ট হিসেবে কোনো তীরবর্তী লোকদল থাকতে পারে, বা কোনো বড় সাবমেরিন। অর্থাৎ সাবমেরিন বলতে যে শক্তিশালী স্বাবলম্বী ডুবোযান আমাদের চোখে ভেসে ওঠে, সাবমার্সিবল কিন্তু তা নয়। তবে সংজ্ঞার দিক থেকে, সকল সাবমেরিনই সাবমার্সিবল, তবে সকল সাবমার্সিবল সাবমেরিন নয়।
কি কি রকম সাবমার্সিবল আছে এই কোম্পানির? আপাতত তিন রকম, অ্যান্টিপোডস, সাইক্লপ্স-১ (৫ জন, ৭২ ঘণ্টা), আর টাইটান (সাইক্লপ্স-২)। টাইটান চার কিলোমিটার নামতে পারে, কার্বন ফাইবার ও টাইটেনিয়াম দিয়ে বানানো কাঠামো। টাইটানের দরজা ভেতর থেকে খোলার কোনো উপায় নেই, বাইরে থেকে শক্ত করে আটকে দেয়া হয়। ভেতরে কোনো নেভিগেশন সিস্টেম নেই, কন্ট্রোল করা হয় একটি গেমিং কন্ট্রোলার দিয়ে, হয়তো অনেকে ব্যবহার করেছেন সেটা- লজিটেকের F710 কন্ট্রোলার! এর কোনো ইমার্জেন্সি লোকেটর বিকনও নেই, অর্থাৎ বিপদে পড়লে এটি কোনো সিগনাল দিতে পারবে না এর অবস্থান নির্ণয় করার জন্য।
টাইটান মাত্র ২২ ফুট দীর্ঘ (৬.৭ মিটার), ভেতরে জবুথবু হয়ে বসে থাকা লাগে, দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। ৯৬ ঘণ্টা পর্যন্ত ৫ জনকে বাঁচানোর মতো অক্সিজেন থাকে এতে। টাইটানে কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিশোধন আর বাতাস পুনঃসঞ্চালনের কোনো সুযোগ নেই। স্পেসএক্সের স্টারলিংক স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হয় টাইটানের ইন্টারনেটের জন্য, অন্তত সেটাই বলা হয়েছিল তাদের আইডি থেকে টুইট করে। মোদ্দা কথা, টাইটান মূলত এক্সপেরিমেন্টাল যান, এটা জেনেই আসলে থ্রিলের জন্য চড়ে বসেন যাত্রীরা। না জেনে নয়! নিজের ঝুঁকিতেই!
এখানে উল্লেখ্য যে,গত ১৬ জুন ২০২৩ সালে নিউফাউন্ডল্যান্ড থেকে যাত্রা করে জাহাজ এমভি পোলার প্রিন্স। ১৭ জুন টাইটানিক ডুবে যাওয়ার ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায় প্রিন্স। ১৮ জুন অতলান্তিক সময় সকাল ৯টায় সাবমার্সিবল অর্থাৎ টাইটান ডাইভ দেয়। প্রথম এক ঘণ্টা ৪৫ মিনিট সব ঠিকই ছিল (১৫ মিনিট পর পর যোগাযোগ), এর পরই সব অন্ধকার- অর্থাৎ আর কোনো যোগাযোগ নেই ওখান থেকে।
সকাল ১১:৪৭ মিনিটের দিকে শেষ কথা হয়েছিল। সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটের দিকে আবার উঠে আসার কথা ছিল টাইটানের। কিন্তু কিসের কি! কোনো খোঁজই নেই। ২২ জুন টাইটানের ৯৬ ঘণ্টার অক্সিজেন শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। হতে পারে টাইটানের কমিউনিকেশন সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেলেও তার চলাচল ক্ষমতা ঠিক আছে। কিংবা হতে পারে এর ব্যালাস্ট সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে, ফলে টাইটান আর ভেসে থাকতে পারেনি যেমনটা থাকার কথা। অথবা, হয়তো টাইটান দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে- বা বিস্ফোরিত হয়ে সাথে সাথেই যাত্রীদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কে কে ছিলেন টাইটানে?
১. দাউদ-হারকিউলিস করপোরেশনের ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ব্যবসায়ী শাহজাদা দাউদ। বয়স তার ৪৮।
২. সুলেমান দাউদ- যিনি কিনা শাহজাদা দাউদের ১৯ বছর বয়সী পুত্র।
৩. ব্রিটিশ ধনকুবের, অ্যাডভেঞ্চারার, বিমানচালক, এবং মহাকাশ-পরিব্রাজক হ্যামিশ হার্ডিং। হার্ডিং ২০১৯ সালে সবচেয়ে কম সময়ে মেরু বরাবর উড়ে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে আসার রেকর্ড স্থাপন করেছিলেন। তার বয়স ৫৮ বছর।
৪. পল-অঁরি নার্জোলে- তিনি একজন ফরাসি নেভি কমান্ডার, ডাইভার, তিনি নিজেও সাবমার্সিবল চালাতে পারেন। তার চালনায় হাজার হাজার আর্টিফ্যাক্ট উদ্ধার করা হয়েছে নানা ধ্বংসস্তূপ থেকে। বয়স ৭৭। তিনি অন্তত ৩৫ বার টাইটানিকের ধ্বংসস্তূপে গিয়েছেন! নিজেই উদ্ধার করেছেন এখান থেকে প্রায় ৫,০০০ আর্টিফ্যাক্ট। তাকে বলা হতো মিস্টার টাইটানিক। প্রথম যেবার টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষে যাওয়া হয়, সেবারও কিন্তু তিনি গিয়েছিলেন সেখানে! প্রথম ছবিগুলো তার ও তার দলেরই তোলা। অবশ্য তিনি জানতেন সেখানে যাওয়াটা কোট বিপজ্জনক, “আপনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারা যেতে পারেন।”
৫. সেই যে সাবমার্সিবলকে সবচেয়ে নিরাপদ যান বলে আখ্যায়িত করেছিলেন- সেই স্টকটন রাশ। ওশানগেইটের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও। তিনিই টাইটানের চালক। বয়স ৬১। রাশের স্ত্রী ওয়েন্ডি রাশ টাইটানিক জাহাজে নিহত দুজন ফার্স্ট ক্লাস যাত্রীর বংশধর। যাত্রী ইসিডর ও আইডা স্ট্রসের গ্রেট-গ্রেট-গ্রেট-গ্র্যান্ড-ডটার এই ওয়েন্ডি। তিনি নিজে তিনবার টাইটানিকের ধ্বংসস্তূপে গিয়েছিলেন।
টাইটানের সার্টিফিকেশন যথেষ্ট ছিল না অত নিচে অভিযান পরিচালনা করার। এর আগেও অন্য অভিযানে দেখা গিয়েছে, ৫ ঘণ্টার জন্য টাইটান যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। সিইও রাশ এই যান পরীক্ষণে রাজি ছিলেন না, একারণে ৩৮ জন মেরিন বিশেষজ্ঞ সতর্ক করেছিলেন রাশকে; ২০১৮ সালে কোম্পানির এক প্রাক্তন কর্মী নিরাপত্তা ইস্যুতে মামলাও ঠুকে দিয়েছিলেন। এছাড়া যে অ্যাক্রিলিকের ভিউপোর্ট দিয়ে আপনি টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখবেন, সেটা ১৩০০ মিটারের মাঝে ঠিকঠাক কাজ করার মতো, এর নিচে গেলে রিস্কি।
মার্কিন কোস্ট গার্ড, নেভি, ও কানাডিয়ান কোস্ট গার্ড মিলে তাদের খোঁজ করেছে, কিন্তু তারা খুব একটা আশাবাদী ছিলেন না, বরং একে আখ্যায়িত করা হয়েছে খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজা হিসেবে। প্রায় ২০,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে খোঁজা হচ্ছিলো।
উদ্ধার অভিযানের সময় আটলান্টিকের তলদেশের এক স্থানে ‘শব্দ’ (ব্যাংগিং সাউন্ড) পাওয়া গিয়েছিল, যা শোনার পর সেখানে খোঁজ বাড়ানো হয়, তবে কোনো আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যায়নি (কোস্ট গার্ড পরে নিশ্চিত করে যে, এ শব্দের সাথে টাইটানের সম্পর্ক ছিল না)।
দুনিয়ার ৭০% হলো এই সাগর-মহাসাগর। অথচ এই সাগরের ৫%-ও এখনও এক্সপ্লোর করা হয়নি মানবজাতির। নিচের নিকষ কালো আঁধারে প্রতি ১০ মিটার নিচে নামা মানে মাথার ওপর প্রতি বর্গইঞ্চিতে ৬.৪৭ কেজি বস্তুর সমান ভার যোগ হওয়া। যেমন, দুই কিলোমিটার নিচে আপনি প্রতি বর্গইঞ্চিতে ১২৭০ কেজি বস্তুর ভার অনুভব করবেন, কিংবা অনুভব করার আগেই মারা যাবেন- যদি না ডুবোযানের পুরু আস্তরণ বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া নিচে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মারা যাওয়াটাও স্বাভাবিক। টাইটানের যদি সবকিছু ঠিকঠাক কাজ করতো তাহলে ওপরে উঠে আসার চেষ্টা করতো নিশ্চয়ই। তবে উঠে এলেও, কেউ যদি খুলে না দেয়, তাহলেও অক্সিজেনের অভাবে মারা যাবেন যাত্রীরা।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে,
২২ জুন বৃহস্পতিবার দিনশেষে মার্কিন কোস্ট গার্ড অফিশিয়ালি তাদের প্রেস ব্রিফিংয়ে জানায় যে, টাইটানিকের ১৬০০ ফুট দূরেই পাওয়া গিয়েছে টাইটানের ধ্বংসাবশেষের অংশ (Tail cone)। Catastrophic Implosion-এ ধ্বংস হয়ে যায় টাইটান। তারা টাইটানের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ খুঁজে পান। ROV (Remotely Operating Vehicle)-এর সাহায্যে প্রথম খুঁজে পাওয়া যায় Nose Cone, এরপর এর কাছে একটি বড় এলাকা জুড়ে ধ্বংসাবশেষ, সেখানে পাওয়া যায় Pressure Hull এর একটি end bell; এসবের কাছে আরেকটি অপেক্ষাকৃত ছোট ধ্বংসাবশেষ এলাকা পাওয়া যায় যেখানে Hull এর বিপরীত পাশের অংশ ছিল।
Implosion মানে ভেতরের দিকে বিস্ফোরণ, বাইরের দিকে নয়; দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া। এখনও ভেতরের যাত্রীদের দেহ নিয়ে কিছু জানা যায়নি, তবে তারা নিশ্চিতভাবেই মৃত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগে টাইটানে করে টাইটানিক পর্যন্ত পৌঁছাতে। দুই ঘণ্টা শেষ হবার ১০-১৫ মিনিট আগেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, তখনই কিছু একটা হয়েছিল, টাইটানিকের একদম কাছে গিয়েই তাদের করুণ মৃত্যু হয়।
বিডিনিউজ ইউরোপ/২৪জুন/জই/টাইটান