জাতিসংঘের ৭৭ তম সাধারণ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার ভাষণ।নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
বাংলায় দেশের ও আন্তর্জাতিক সমস্যাদি নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন।বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে ৭৭ তম সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের জাতীয় বিষয়গুলো যেমন বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেছেন, তেমনি আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গগুলোর প্রতিও সমান গুরুত্ব আরোপ করেছেন তিনি।বাংলাদেশের জাতীয় সংবাদ মাধ্যম ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভয়েস অফ আমেরিকার খবরে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কোভিড পরবর্তী বিশ্বে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমাদের প্রমাণ করতে হবে যে সংকটের মুহূর্তে বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো জাতিসংঘ। তাই সর্বস্তরের জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনের জন্য জাতিসংঘকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে সকলের প্রত্যাশা পূরণে কাজ করতে হবে।”
তিনি তাঁর ভাষণের শুরুতেই এই ৭৭তম অধিবেশনের সভাপতিকে অভিনন্দন জানান এবং জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে দায়িত্ব পালনকালে জাতিসংঘকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলতে তাঁর দৃঢ় প্রতিশ্রুতির জন্য সাধুবাদ জানান। তিনি সেইসাথে ‘গ্লোবাল ক্রাইসিস রিসপোন্স গ্রুপ’ গঠন করার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, “এই গ্রুপের একজন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে, আমি বর্তমান পরিস্থতির গুরুত্ব ও সংকটের গভীরতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বৈশ্বিক সমাধান নিরূপণ করতে অন্যান্য বিশ্বনেতাদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি।“ তিনি বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন, সহিংসতা ও সংঘাত, কোভিড-১৯ মহামারির মত একাধিক জটিল ও বহুমাত্রিক প্রতিকুলতা মোকাবিলায়, অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করে শান্তিপূর্ণ ও টেকসই পৃথিবী গড়ে তুলতে যে আহ্বান জানানো হয়েছে তাতে এখনই সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে”।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “করোনাভাইরাস মহামারির মারাত্মক প্রভাব এবং তার পরই রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত বিশ্বকে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, জ্বালানি এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তিনি বলেন এই সংকটময় সময়ে অতীতের যে কোন সময়ের তূলনায় আরো বেশি করে পারস্পরিক সংহতি প্রদর্শনের প্রয়োজন রয়েছে”। তিনি রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান চান বলে উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বাংলাদেশের ত্রিমুখী কৌশলের কথা উল্লেখ করেন।
এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের সাফল্যের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম। গত এক দশকে বাংলাদেশে দারিদ্রের হার ৪১ শতাংশ থেকে ২০.৫ শতাংশে নেমে এসেছে এবং মাথাপিছু আয় এক দশকে তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়ে এখন ২,৮২৪ আমেরিকান ডলারে উন্নীত হয়েছে। সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা, মা ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাস, লিঙ্গ বৈষম্য কমানো ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখেযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে”।
তিনি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, “বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের সঙ্গে এবং টেকসই উন্নয়নে অভিষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অসংখ্য পদক্ষেপ নিয়েছে”। তিনি বিশ্বব্যাপী অভিবাসন সমস্যার কথাও তুলে ধরেন এবং বাংলাদেশে তাঁর সরকারের নেওয়া গৃহহীনদের জন্য ‘আশ্রয়ন’ প্রকল্পের কথা উল্লেখ করেন।
ভাষণে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থীদের প্রসঙ্গ সবিস্তারে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে বাস্তুচ্যূত রোহিঙ্গাদের নিরাপদে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে জাতিসংঘ গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন “রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে দীর্ঘ অবস্থানের কারণে গোটা দেশ এবং গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে”।
ভাষণের শুরুতে তিনি বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণের কথা উল্লেখ করেন এবং ভাষণের উপসংহারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে হত্যার করুণ ঘটনা তুলে ধরেন। তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথাও বলেন এবং বলেন, যুদ্ধ নয় তিনি শান্তি চান ।
এখানে উল্লেখ্য যে,বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের জন্য গত সোমবার লন্ডন থেকে নিউ ইয়র্কে এসে পৌঁছান।
শেখ হাসিনা জাতিসংঘের এই ৭৭তম অধিবেশনে ভাষণ প্রদান ছাড়াও এখানে অত্যন্ত কর্মব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। ২০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতারেসের দেয়া সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ৭৭তম অধিবেশনের উদ্বোধনী অধিবেশনে যোগ দান ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দেওয়া একটি সম্বর্ধনা সভায় অংশ নেন এবং নারী নেতৃত্বের উপর একটি অনুষ্ঠান UNGA Platform of Women Leaders-এ যোগ দেন।
এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শরনার্থী বিষয়ক জাতিসংঘের হাই কমিশনার ফিলিপো গ্রান্ডি ও স্লোভেনিয়ার প্রেসিডেন্ট, এবং বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ও বৈশ্বিক বিষয়ে পৃথক পৃথক বৈঠক করেছেন। তিনি বাংলাদেশ, বোত্সওয়ানা, স্লোভাক প্রজাতন্ত্র এবং ইউ এন হ্যাবিটাটের সম্মিলিত উদ্যোগে আয়োজিত টেকসই আবাস বিষয়ক উচ্চ-লেভেলের অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
শনিবার ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর নিউ ইয়র্কে এক নাগরিক সভায়ও যোগ দেবার কথা রয়েছে। তারপর তিনি নিউ ইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে আসবেন। আগামী ৪ অক্টোবর তাঁর বাংলাদেশে ফেরার কথা রয়েছে।
বিডিনিউজ ইউরোপ২৪ডটকম/২৫সেপ্টেম্বর/জই