বঙ্গোপসাগরে ভাসমান স্বর্ণ: বদলে দিতে পারে দেশের ভাগ্য!
বঙ্গোপসাগরে পাওয়া যায় ‘ভাসমান স্বর্ণ’ নামে পরিচিত তিমির বমি। স্বর্ণের সাথে তুলনা করা হলেও বাস্তবে এর বাজারমূল্য স্বর্ণের চেয়েও বেশি। বিশে^র দেশভেদে এই তিমির বমি বা এ্যাম্বারগ্রিস বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৭০ হাজার ডলার থেকে ১লাখ ২০ হাজার ডলারে, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় হয় প্রায় কোটি টাকা। গবেষকরা বলছেন, বঙ্গোপসাগর থেকে তিমির বমি বা এ্যাম্বারগ্রিস সংগ্রহের মাধ্যমে বদলে যেতে পারে দেশের ভাগ্য! বর্তমানে এই মূল্যবান সম্পদটি সংগ্রহের অভাবে প্রকৃতিতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
গবেষকরা বলছেন, একটি তিমি প্রতিদিন তার গৃহীত খাদ্যের শতকরা প্রায় দশভাগ বমি হিসাবে ত্যাগ করে। তবে একটি তিমি প্রতিদিন ২ কেজি করেও যদি এ্যাম্বারগ্রিস উৎপাদন করে, তাহলে সে বছরে ৭০০ কোটি টাকার এ্যাম্বারগ্রিস উৎপাদন করছে। আর বঙ্গোপসাগরে যদি মাত্র এক হাজার তিমিও থাকে, তাহলে বছরে উৎপাদন হচ্ছে ৭ লক্ষ কোটি টাকার এ্যাম্বারগ্রিস; যা দেশের জাতীয় বাজেটের চেয়েও বড়।
ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (Wildlife Conservation Society -WCS)) সর্বশেষ জরীপ মতে, বাংলাদেশে পাঁচ প্রজাতির তিমিসহ ১৩ প্রজাতির সিটাসিয়ান বা জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। তবে বাংলাদেশে থাকা পাঁচ প্রজাতির তিমির মধ্যে দুই প্রজাতির তিমি থেকেই এ্যাম্বারগ্রিস উৎপাদিত হয় বলে জানান বিএফআরআই’র সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হক।
তিনি জানান, তিমিদের মধ্যে তিন প্রজাতির স্পার্ম হুয়েল বা শুক্রাণু তিমি থেকে এ্যাম্বারগ্রিস উৎপাদিত হয়। যার মধ্যে দুই প্রজাতির তিমি আমাদের বঙ্গোপসাগরেও পাওয়া যায়। তিমি দুটি হল- ফিসেটার ম্যাক্রোসেফালাস (Physeter macrocephalus) ও কোজিয়া সিমা (Cogia sima)।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, বঙ্গোপসাগরের মহীসোপান ও মহীঢালে স্পার্ম হুয়েল জাতের তিমিরা বিচরণ করে। সোয়াচ অব নো-গ্রাউন্ড ছাড়াও সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে এসব তিমির বিচরণ লক্ষ্য করেছেন বিজ্ঞানীরা। তবে এসব মূল্যমান ‘ভাসমান স্বর্ণ’ আহরণ করাই এক চ্যালেঞ্জ।
তিনি জানান, সমুদ্র থেকে সহজে এ্যাম্বারগ্রিস আহরণ সহজ না হলেও এগুলো যখন সৈকতে ভেসে আসে, তখন সংগ্রহ করা যায়।
গত বছরের মার্চ মাসে থাইল্যান্ডের ৪৯ বছর বয়সী এক নারী সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়ে এক খন্ড অ্যামবারগ্রিস বা তিমির বমি খুঁজে পান। যার বাজারমূল্য ছিল আড়াই লক্ষ মার্কিন ডলার। যা বাংলাদেশী মুদ্রায় হয় আড়াই কোটি টাকার কাছাকাছি।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্থান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, সিরিপর্ন নিয়ামরিন নামের ওই নারী থাইল্যান্ডের নাখন সি থাম্মারাট প্রদেশের বাসিন্দা।
এর কয়েক মাস আগে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইলের খবরে বলা হয়, তিমির বমি পেয়ে রাতারাতি কোটিপতি হয়ে গেছেন থাইল্যান্ডের এক জেলে (২০২০ সালের ডিসেম্বরে)। নারিস নামের ওই জেলে তিমির বমি খন্ডটি প্রায় ২৪ লাখ পাউন্ড বা ২৭ কোটি ১০ লাখ টাকায় বিক্রি করেন।
বিএফআরআই’র কক্সবাজার স্টেশনের প্রধান ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান জানান, শুধু থাইল্যান্ড নয়- বিশে^র বিভিন্ন সৈকতে তিমির বমি বা এ্যাম্বারগ্রিস পাওয়া যায়। আমাদের কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন সৈকতেও হয়তো তিমির বমি ভেসে আসে। তবে আমরা চিনতে পারিনা বলে তা সংগ্রহ করতে পারছি না।
ভারতের উড়িষ্যার কেএম কলেজ অব বেসিক সায়েন্স এর অধ্যক্ষ ড. গোবিন্দ চন্দ্র বিসওয়াল বলেন, তিমির বমিকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় অ্যাম্বারগ্রিস বলা হয়। এটি তিমির দেহ থেকে নির্গত বর্জ্য যা তিমির অন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসে।
তিনি জানান, কখনও এটি প্রাণীটির মলদ্বার দিয়ে বেরিয়ে আসে, আবার কখনও পদার্থটি বড় হয়ে গেলে মুখ দিয়ে বের করে দেয়।
ড. বিসওয়াল বলেন, অ্যাম্বারগ্রিস আসলে একটি শক্ত ও মোমের মতো জ্বলনীয় পদার্থ। সাধারণত তিমি সৈকত থেকে অনেক দূরে থাকে। তাই তাদের দেহ থেকে এই উপাদানটি সমুদ্র সৈকতে পৌঁছাতে অনেক বছর সময় লাগে। তবে মৃত তিমি ভেসে এলে তাদের পাকস্থলী থেকে সরাসরি পদার্থটি সংগ্রহ করা যায়।
বিজ্ঞানীরা জানান, পারফিউম তৈরিতে এ্যাম্বারগ্রিস একটি হার্ট বা বেস নোট হিসাবে ব্যবহৃত হয়, যেটি পারফিউমের সুগন্ধিকে দীর্ঘস্থায়ী করে তোলার অনন্য ক্ষমতা রাখে। অ্যাম্বারগ্রিস শুধুমাত্র সুগন্ধি তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয়। এটি দীর্ঘকাল ধরে একটি শক্তিশালী কামোদ্দীপক হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অ্যাম্বারগ্রিসে থাকা ফেরোমন হরমোন সিস্টেমকে উদ্দীপিত করে। এছাড়া এথনো মেডিসিন বা ঐতিহ্যগত ওষুধ হিসাবে সারা বিশে^ই হৃদপিন্ডজনিত সমস্যা, মস্তিষ্কের সমস্যা ও মাথাব্যথা, পেশী টান, স্নায়বিক রোগ, মুখের পক্ষাঘাত, মৃগী রোগ এবং বিষন্নতার চিকিৎসায় তিমির বমির ব্যবহার রয়েছে।
ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির বাংলাদেশ কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, বঙ্গোপসাগরের ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’-এ দুই জাতের স্পার্ম হুয়েলসহ পাঁচ জাতের তিমি, ৭ জাতের ডলফিন ও একজাতের পরপইস দেখা যায়। এছাড়া কক্সবাজারসহ দেশের উপকুল থেকে ৪০ কি.মি দূরে এবং সেন্টমার্টিনের আশেপাশের সাগরেও তাদের বিচরণ দেখা যায়।
তিনি জানান, ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির ২০০৪ সালের জরীপে বঙ্গোপসাগরে প্রায় ১৬ হাজার ডলফিন শনাক্ত হয়েছে। যারমধ্যে প্রায় ৬ হাজার রয়েছে ইরাবতি ডলফিন। তবে বঙ্গোপসাগরে তিমির মজুদ শনাক্ত করা যায়নি।
উল্লেখ্য, গত বছর এপ্রিলে কক্সবাজারের হিমছড়ি সৈকতে দুটি এবং আগের বছর টেকনাফ সৈকতে একটি মৃত তিমি ভেসে আসে। এছাড়া গতবছর নভেম্বরে কুয়াকাটা সৈকতে একটি মৃত তিমি ভেসে আসে। তিমি চারটির মধ্যে দুটি বলিন জাতের এবং অপর দুটি স্পার্ম হুয়েল জাতের বলে শনাক্ত হয়েছে। তবে চারটি তিমিই সৈকতে পুঁতে ফেলা হয় এবং পরবর্তীতে এর অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো সাগরে ভেসে যায়।
বিডিনিউজ ইউরোপ২৪ডটকম/২৮জুন/জই