ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চল থেকে ধীরে ধীরে তাতার মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হচ্ছে। রুশ সেনারা সুকৌশলে সেই কাজটি করে যাচ্ছে।তাদের সেই কাজে বাধা দিলে তাদের গ্রেফতার ও নির্যাতন করা হচ্ছে। এমনকি তুলে নিয়ে গুম করার একাধিক ঘটনাও ঘটছে।বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনে সামরিক অভিযান পরিচালনার পর দখলে নেয়া অঞ্চলগুলোতে একই মডেলে রাশিয়া নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার একটি প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্ব শহর মেলিতোপোলে লেইলা ইব্রাগিমোভার বাড়িতে অভিযান চালায় রুশ সেনাদের সাতজনের একটি দল। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে বাসা থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায় তারা।ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপদ্বীপ ক্রিমিয়ার সংখ্যালঘু তাতার মুসলিম জনগোষ্ঠীর একজন ইব্রাগিমোভা। তিনি শহরে একজন সুপরিচিত নারী।ওই দিন ইব্রাগিমোভাকে জোর করে একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় রুশ সেনারা। সেই গাড়িতে করেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একটি অজ্ঞাত স্থানে তাকে নিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় স্থানীয় ক্রিমিয়ার তাতার সংগঠন আজাদ এবং তার এলাকার নেতাকর্মীদের নাম-ঠিকানা সম্পর্কে ইব্রাগিমোভার কাছে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু ইব্রাগিমোভা ওই ব্যক্তিদের সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে চাননি।
রুশ সেনারা যে অবৈধ কর্মকাণ্ড করছে জিজ্ঞাসাবাদের সময় ইব্রাগিমোভা তা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন, এই অঞ্চলটি এখনো ইউক্রেনের। এখানে রাশিয়ার আইন মানা হয় না।ইব্রাগিমোভাকে ওই দিনের পর ছেড়ে দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনেনি রুশ দখলদার বাহিনী।শুধু ইব্রাগিমোভা নন, এখন পর্যন্ত ক্রিমিয়ায় প্রায় ২০ জন নিখোঁজ হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনী তাদের অপহরণ করেছে। এখনো তাদের কোনো খোঁজ নেই। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের মেরে ফেলা হয়েছে।
ক্রিমিয়ার তাতারদের বিরুদ্ধে এভাবেই ব্যাপকভাবে দমন-পীড়ন করছে রুশ সেনারা। দিন দিন এটা আরও বাড়ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।রুশ নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চল নিয়ে পরিকল্পনা
বিশ্লেষকরা বলছেন, গত দুই সপ্তাহে নিয়ন্ত্রণে নেয়া ইউক্রেনের অঞ্চলগুলোর বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করছে রাশিয়া। সেটি বাস্তবায়নে নানা কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে। এই গ্রেফতার কৌশল সেই পরিকল্পনা সম্পর্কে ধারণা দেয়।ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোপীয় ইসলাম অনুষদের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নেদিম ইউসিনো আল-জাজিরাকে বলেন, ‘ইব্রাগিমোভাকে আটকের লক্ষ্য ছিল তাকে হুমকি দেয়া। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন সম্পর্কে তথ্য নিয়ে তাদের পরবর্তীতে টার্গেট করা। এটা রাশিয়ার খুবই সুপরিচিত একটি কৌশল। ২০১৪ সাল থেকে ক্রিমিয়ায়ও তারা একই কাজ করছে’।
ইউসেইনো বলেন, রাশিয়ার পরিকল্পনা দেখে মনে হচ্ছে, তারা সমুদ্রে স্থায়ীভাবে ইউক্রেনের প্রবেশ বন্ধ করে দেবে এবং দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলোকে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ড ও ক্রিমিয়ার সঙ্গে যুক্ত করবে।তিনি বলেন, রাশিয়া দিনিপ্রো নদীর পানির নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। কেননা তারা এখনো ক্রিমিয়ায় পানির ঘাটতির সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, তারা কিছু ক্রিমিয়ার তাতার সহযোগীদেরও খেরসন অঞ্চলে আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য আনতে শুরু করেছে।
অ্যাকটিভিস্টদের ওপর নিপীড়ন
বিশ্লেষকরা বলছেন, দখল করা ক্রিমিয়া অঞ্চলে মুসলিম তাতারদের বিরুদ্ধে রাশিয়া কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে সেটা দেখলে খুব সহজেই বোঝা যায়, ইউক্রেনের দখল নেয়া অঞ্চলগুলোর অ্যাকটিভিস্ট, কর্মকর্তা ও নেতাদের সঙ্গে আগামীতে কী ঘটতে যাচ্ছে।পোলিশ হেলসিংকি ফাউন্ডেশন ফর হিউম্যান রাইটসের লেনুর কেরিমোভ আল-জাজিরাকে বলেন, ক্রিমিয়া অঞ্চল রাশিয়ার দখলে যাওয়ার পর থেকেই ক্রিমিয়ার তাতারদের অবস্থা কঠিন হয়ে পড়ে। রুশ দখলের বিরুদ্ধে ও শুদ্ধি অভিযাবের বিপক্ষে কথা বলা অ্যাকটিভিস্টদের গণহারে নির্যাতন করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ক্রিমিয়ার প্রায় ২০ জন নিখোঁজ হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনী তাদের অবহরণ করার পর থেকে আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এটি জনগণের মনোবলকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্রিমিয়ার তাতারদের ওপর দমন-পীড়ন আংশিকভাবে ধর্মের কারণে হলেও এর প্রধান কারণ হলো, তাদের বড় একটা অংশ ক্রিমিয়া দখলের বিপক্ষে কথা বলেছে এবং গণমাধ্যমে এর সমালোচনা করেছে।২০১৪ সালে দখলের পর থেকে ৮ বছর ধরে ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। অ্যাকটিভিস্টদের বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছে। ক্রিমিয়ার তাতারদের স্বাধীন গণমাধ্যমগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আবার যেগুলো চালু আছে, সেখানে স্থানীয় সাংবাদিকদের রাজনীতি থেকে বিনোদনমূলক কার্যক্রমে ফোকাস করতে বলা হয়েছে। স্থানীয় গণমাধ্যমে এখন পূর্ণ সেন্সরশিপ রয়েছে।
কাগজে-কলমে ক্রিমিয়ার তিনটি দাপ্তরিক ভাষা রয়েছে। সেগুলো হলো- রুশ, ক্রিমিয়ান তাতার ও ইউক্রেনীয়। স্থানীয় অ্যাকটিভিস্ট ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রিমিয়ার তাতার এবং ইউক্রেনীয় ভাষার স্কুলগুলোকে শিক্ষাদান থেকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।লেনুর কেরিমোভ বলেন, এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে তাতার পরিচয় এবং সংস্কৃতির সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেখানে যেকোনো নাগরিক আন্দোলন ভণ্ডুল করে দেয়া হচ্ছে। সেখানকার রাজনীতিও এখন রাশিয়ানদের নিয়ন্ত্রণে।
তিনি বলেন, ১০০ জনেরবেশি ক্রিমিয়ান তাতার রয়েছেন, যাদের রাশিয়ার কারাগারে দীর্ঘ সময় ধরে বন্দি করা হয়। তাদের অধিকাংশই মুসলমান।তাতারদের মুছে ফেলার দীর্ঘ কৌশল
১৯৪৪ সালে ক্রিমিয়ায় প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার তাতার বসবাস করতো। তাদের প্রধান পেশা ছিল পশুপালন। ওই সময় ক্রিমিয়া অঞ্চলটি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ছিল।সোভিয়েত শাসক জোসেফ স্তালিনের রোষানলে পড়ে তাতাররা মধ্য এশিয়ায়, বিশেষত উজবেকিস্তানে পাড়ি জমায়। ওই কষ্টকর যাত্রায় ক্ষুধা, শীত ও রোগে প্রায় অর্ধেক তাতার মারা যান বলে ধারণা করা হয়। এ ঘটনাকে গণহত্যা হিসেবে উল্লেখ করে ইউক্রেনসহ কয়েকটি দেশ।১৯৯১ সালে ইউক্রেনের স্বাধীনতার পর ক্রিমিয়া অঞ্চলটি রাশিয়ার হাতছাড়া হয়ে যায়। ২০১৪ সালে অঞ্চলটি আবার দখলে নেয় রাশিয়া। ইউক্রেনে রুশ অভিযান শুরুর পর অঞ্চলটির পুরো নিয়ন্ত্রণ এখন সেনাদের হাতে। সেখানে এখন মাত্র ১২ হাজার তাতার মুসলিমের বাস।
বিডিনিউজ ইউরোপ২৪ডটকম/১৩মার্চ/জই