বাংলাদেশের মফস্বল সাংবাদিক দায়িত্বের আবহে সমাজের বাস্তবতায় ঘটনা নিয়ে লিখনী যা জনগুরুত্বপূর্ণ। মফম্বলের সাংবাদিক হিসাবে আমার কর্ম এলাকায় আকার প্রকারভেদে সবচেয়ে বেশি সংহিংসতার ঘটনা ঘটে পারিবারিক বিরোধ থেকে । ভাইয়ের হাতে ভাই, ছেলের হাতে বাবা, মা, মায়ের হাতে ছেলে, ভাইয়ের হাতে ভাই খুন জখমের ঘটনা ছাড়াও আরো কত বিষয় । দেশের সকল পত্রিকাতেই ফলাও করে ছাপা বা প্রকাশ করা হয় । এখানে এক বড়ভাই তার ছোট ভাইকে দোষী করে বাবা মাকে অবজ্ঞা করে । নাম উল্লেখ না করে লিখি । এতে ঘনিষ্ঠ মানুষের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। মন্দ সকল খবর আমরা প্রচারের চেষ্টা করি।
আবার পারিবাহিক স্নেহ মমতা, ভালবাসার ঘটনাও ঘটে । এসব খুব একটা মিডয়ায় আসে না । অথচ পারিবারিক অপরাধ সম্পর্কিত ঘটনা ফলাও করে প্রচার করা হলেও এই পরিবারের ভালোবাসার বন্ধন নিয়ে খুব একটা লিখি না । লিখলে হয়তো মানুষ সংশোধনের সুযোগ পেতো । আবেগ অনুভূতিগুলো আরো বেশি চাঙ্গা হতো পরিবারের সদস্যদের মাঝে ।অনুসন্ধানে দেখেছি, মানুষের নিজের পরিবার থেকেই হিস্রতার স্বভাবটা বেড়ে উঠে । পারিবারিক কারণেই নিরীহ গোবেচারা, সহজ সরল শিশুটি মনে মনে পোষন করতে থাকে, বিদ্বেষ-ঘৃণা, হিংস্র, আগ্রাসী, নৃশংসতার। কৈশরে অথবা বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার মাঝে আরো প্রকট আকারে বেড়ে উঠতে থাকে, জেদী ভাব, বিরক্ত হওয়া, রাগী ভাব, হতাশায়, সন্দেহে , ঈর্ষায়, অসহায়ত্ব, উদ্রেক-উৎকণ্ঠায় । এরই মাঝে সৃষ্টি হতে থাকে ভয়ের মাঝে নেতিবাচক অনুভূতি। ক্রমান্বয়ে জগদ্দল পাথরের মত চেপে রেখে অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে থাকে । কত হাজাহাজি বা বড় আকারের রক্তপাতের সংঘর্ষ ঘটে ।
ডিজিটাল যুগে অনলাইন ভিডিও গেম যা অধিকাংশই থাকে রক্তপাত ও হিংস্রতার আবরণে। এইসব শিশুদের জমে থাকা হিংসাগুলো প্রয়োগ হয় বিশাল পরিসরে । পরিবার থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রয়োগ হয়- ভিন্ন মত, অপরাপর ধর্ম, অপরাপর ভাষা ও সংস্কৃতির উপর । অবিশ্বাস তাদের দূরে ঠেলে দেয় মন মানসিকতার ধ্বসে । ভাল মানুষও আছে এসমাজে। বড় মনের সংযত কণ্ঠস্বর তারা । সমাধানের নেশায় অবিচল থাকেন শুভবুদ্ধি প্রয়োগে। আদর্শ, নিঃস্বার্থ, ভালোবাসা সৃষ্টির পথ প্রদর্শকের কাজ করেন । পারিবারিক সম্পর্ক উত্তীরণে বিশ্বাস বাড়াতে, বিরাগ, তিক্ততার দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করেন । মানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অসুস্থ্যকে সুস্থ্য করা, মিথ্যাকে সত্য বলানো, অপরাধীকে সমর্থন না দিয়ে শাস্তির ভয় দেখিয়ে সুধরে আনার চেষ্টা, ছেড়া সম্পর্কগুলিকে জোড়া লাগানোর কাজ অর্থাৎ রিস্টোরেটিভ জাস্টিসের প্রয়োগের মাধ্যমে সামাজিক বিরোধ মিমাংসার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের বিরোধকে শান্তির পুষ্প বৃষ্টি ছেটান ।
পারিবারিক গৃহবিবাদের মধ্যে আরো একটি মারাত্নক ঘটনা ঘটে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ , হানাহানি, কলহ আরো কত ঘটনা। নির্যাতনের শিকার, অধিকার বঞ্চিত, অসহায় নারীদের ভরণপোষন, ক্ষতিপূরণ প্রতিষ্ঠা করার দায় আমাদেরও কম নয় । সমাজে এখনও নারীদের দায়ী করে প্রচলিত আছে, ভাই বড় ধন রক্তের বাধন । যদিও পৃথক হয় নারীর কারণ ।
অনুসন্ধানী চিন্তার মাধ্যমে সংবাদের খোজে বিচরণ করতে হবে ।সংবাদ সংগ্রহের মাধ্যমে সংবাদপত্রে ও যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠা এবং এই সব বাজে কথাকে মিথ্যা প্রমান করার দায়িত্বও আমার বা আমার মত সাংবাদিকদের ।
কথায় আছে, ‘ভাই বড় ধন রক্তের বাঁধন।’ ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার এনায়েতপুর ইউনিয়নের পাহাড়গাঁও গ্রামের বাসিন্দা দুই ভাই যেন তেমনই। বয়সে আজ তারা প্রবীণ ।
শারীরিক প্রতিবন্ধী ছোট ভাই আমিনুল ইসলামকে দীর্ঘ ৪০ বছর সন্তানের স্নেহে লালনপালন করেছেন বড় ভাই রইছুল্লা। নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিদিন। নেই কোনো ক্লান্তি, নেই কোনো বিরক্তি। যেন ভাই না সন্তান।স্থানীয়রা জানালেন, দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে এই সেবা দিয়ে যাচ্ছেন বড় ভাই। প্রতিবন্ধী আমিরুল তার দুই হাত দুই পা দিয়ে কিছুই করতে পারেন না । মুখে খাবার তুলে দেয়া, চুল দাড়ি কেটে দেয়া, গোসল , প্রশ্রাব- পায়খানা- এক কথায় সবকিছুই করিয়ে দেন বড় ভাই।
অনেকেই বলে থাকেন, দয়াদাক্ষিণ্য আজকাল অনেকেই বিশ্বাস করেন না । তারা মনে করেন না এতে সমাজবদল হয়। চ্যারিটির মাধ্যমে তা হতে পারে না। বস্তু, মাইক্রোস্কেলে সমাজ সংস্কার হতে পারে, এই ধ্যানধারণায় তাদের অবিশ্বাস ।কিন্তু, তাদের এই ধ্যানধারণা সম্পর্কে সন্দেহ জাগাবে ছোট ভাইয়ের প্রতি বড় ভাইয়ের মানবতা । অচল হয়ে পড়ে থাকা ছোট ভাইকে পরম মমতায় লালন করছেন- এমন দৃশ্য দেখে তাদের এ ধারণা পাল্টে যাবে। ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের এমন সহমর্মিতা , মানবিক মান্যতা দেয়ার চেষ্টা বর্তমান সমাজে বিরল।আমাদের সমাজে অত্যাচার, অবিচারের মধ্যে থাকা প্রান্তিক মানুষগুলোর জীবনযাত্রাকে ছোঁয়া এদৃশ্য শ্রদ্ধা, সম্মানেরই বার্তা বহন করে। ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসেব করছেন না এই বড় ভাই ।
সমাজে হিংসা বাড়ছে। বাড়ছে নিষ্ঠুরতা। আর এরই মধ্যে এই বড় ভাই যেন নীরব বিপ্লব করে যাচ্ছেন ।
বিডিনিউজ ইউরোপ২৪ডটকম/৪মার্চ/জই