অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় বাংলাদেশী কোরআন স্কুলে বিশেষ ইসলামী ইলমী জলসা অনুষ্ঠিত !গত রোববার (২৭ ফেব্রুয়ারী) ভিয়েনার ১৫ নাম্বার ডিস্ট্রিক্টের মাদানী কোরআন স্কুলে এক বিশেষ ইসলামী জ্ঞ্যানের আলোচনার আয়োজন করে অস্ট্রিয়া বাংলাদেশ কমিউনিটির সিনিয়র ইমাম ড.ফারুক আল মাদানী হুজুরের প্রতিষ্ঠিত মাদানী কোরআন স্কুল। এই কোরআন শিক্ষার স্কুলটি বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক স্কুলে রুপান্তরিত হয়েছে। বর্তমানে ভিয়েনায় বসবাসরত অস্ট্রিয়ান সহ প্রায় ৫৫ টি দেশের ছোট ছেলেমেয়েরা পবিত্র কোরআন শিক্ষা গ্রহণ করছে। এই কোরআন স্কুলে বিভিন্ন বিভাগের সাথে আলহামদুলিল্লাহ একটি হেফজখানাও আছে। কোরআন শিক্ষার এই স্কুলটি সামান্য সময়ের মধ্যেই ভাল সাফল্য লাভ করেছে। এই স্কুল থেকে বর্তমানে ৪(চার) জন কোরআনে হাফেজ হয়েছেন। এর মধ্যে ৩ জন আমাদের অস্ট্রিয়া বাংলাদেশ কমিউনিটির দ্বিতীয় প্রজন্মের সন্তান এবং চতুর্থ হাফেজ একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত অস্ট্রিয়ার দ্বিতীয় প্রজন্মের সন্তান।
এই বিশেষ ইসলামি জ্ঞ্যানের আলোচনার অনুষ্ঠানের
বক্তব্য রাখেন অস্ট্রিয়া বাংলাদেশ কমিউনিটির সন্মানিত ইমাম সাহেবগণ। অসুস্থ ও বাংলাদেশে ছুটিতে
থাকায় আরও একাধিক ইমাম সাহেব উপস্থিত থাকতে
পারেন নি। এই বিশেষ ইসলামি ইলমী অনুষ্ঠানের আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আমাদের কমিউনিটির সন্মানিত ইমাম মাওলানা আবদুস সাত্তার সাহেব,
শাইখ আব্দুল মতিন আল আজহারী সাহেব এবং
শাইখ ড. ফারুক আল মাদানী সাহেব।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহর ঘোষণা, ” كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ (কুল্লু নাফসিন জায়েকাতুল মাউত) অর্থাৎ প্ৰত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদগ্রহণ করতে হবে ৷” এ ব্যাপারে আমাদের করনীয় কি? এই প্রতিপাদ্য নিয়ে
দীর্ঘদিন পর অস্ট্রিয়া বাংলাদেশ মুসলিম কমিউনিটির
এই ইসলামি জ্ঞ্যানের আলোচনার প্রথমেই পবিত্র কোরআন থেকে সূরা আল মূলকের প্রথম কয়েকটি
আয়াত তেলাওয়াত করেন অস্ট্রিয়া বাংলাদেশ কমিউনিটির সিনিয়র সিটিজেন জনাব জসিম উদ্দিন সরকার।
কোরআন ও হাদীস ভিত্তিক এই বিশেষ আলোচনা
অনুষ্ঠানের প্রথম বক্তা হিসাবে মাওলানা আবদুস সাত্তার সাহেব বলেন,মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল
আলামিন মানুষকে এই দুনিয়াতে পাঠিয়ে গাইড লাইন
হিসাবে আবার যুগে যুগে আমরা যেন সঠিক লাইনে
থাকতে পারি, তার জন্য নবী ও রাসূলদের পাঠিয়েছেন।
আদি পিতা হযরত আদম আঃ থেকে শুরু করে শেষ নবী ও রাসূল মোহাম্মদ সাঃ এর পর আমাদের জন্য আল্লাহর এই দূত পাঠানো শেষ হয়েছে। এই নবী ও
রাসূলগণ আমাদের জন্য মহান আল্লাহতায়ালার এক
বিশেষ নিয়ামত।
তিনি পবিত্র কুরআনে সূরা আল বাকারায় বর্ণিত হযরত আদম আঃ এর সৃষ্টির বিস্তারিত বর্ণনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত
আকারে আলোচনা করেন। তিনি পবিত্র কুরআনের আলোকে বলেন,আল্লাহ সকল মানুষের জীবন বা রুহ একসাথে সৃষ্টি করেছেন। আদি পিতা ও মানব হযরত আদম আঃ থেকে শুরু করে আজ অবধি আমরা
মানুষ আল্লাহর সিরিয়াল অনুযায়ী দুনিয়াতে জন্মগ্রহণ করছি এবং মৃত্যুবরণ করছি। মানুষের রুহ” ধ্বংস হয়না,শুধুমাত্র স্থান পরিবর্তন হয়।
মৃত্যু এমন এক বিষয়। যার হাত থেকে পলায়ন করার সাধ্য কারো নেই। এ কথা বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহতাআলা যার মৃত্যু যেখানে নির্ধারিত করে রেখেছেন; সেখানেই তাঁর মৃত্যু হবে। এটাই মহান
সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার বিধান। মৃত্যু যে নির্ধারিত সময় ও স্থানে সুনিশ্চিত তা পবিত্র কোরআন ও
হাদিসে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। বক্তব্যের
সারমর্মে তিনি বলেন,আমাদের সকলকে তাই
কোরআন ও হাদিসের আলোকে মৃত্যুর পূর্বেই মৃত্যুর
প্রস্তুতি নিতে হবে।
দ্বিতীয় বক্তা হিসাবে শাইখ আব্দুল মতিন আল আজহারী সাহেব বলেন,আমাদের বিশ্বনবী রাসূল মোহাম্মদ সাঃ ও সাহেব রাঃ গণের মত এমনভাবে
জীবন ধারণ করতে হবে যে,সকাল বেলা ভাবতে হবে
যে,আমি আর বিকাল নাও পেতে পারি। যারা বর্তমানে
আমাদের কবরে শুইয়ে আছে তারাও এই মাত্র কয়েক
দিন পূর্বেই আমাদের মতই এই পৃথিবীর মধ্যেই ছিলেন।
আজ তারা কবরে তাদের দুনিয়ার কৃতকর্মের ফল ভোগ করছেন। যারা জীবদ্দশায় আল্লাহ ও রাসূল সাঃ এর
নির্দেশিত পথে জীবন পরিচালিত করে মৃত্যুবরণ করেছেন তারা সুফল ভোগ করছেন। আর বিপরীতে
যারা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ ও নবী-রাসূলগণের কথা মত চলেন নি,তারা তাদের কৃতকর্মের সাজা ভোগ করছেন।
তিনি আরও বলেন,আমাদেরকে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর
পূর্বেই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। তবে
মৃত্যুর প্রস্তুতির জন্য আমাদের মাঝে দুইটি জিনিস
বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তার একটি হল দুনিয়ার জীবনের
প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা,আর অন্যটি হল মৃত্যুকে
অপছন্দ করা। যে যত বেশী দুনিয়ার জীবনকে ভালবাসবে সে তত মৃত্যুর চিন্তা থেকে দূরে সরে যাবে।
এ প্রসঙ্গে শাইখ মতিন সাহেব একটি হাদিস বলেন,
নবী পত্নী হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাঃ এর কাছে
এক মহিলা এসে বললেন যে,তার ইবাদতে মন বসে
না এবং ইসলামের হুকুম আহকামের প্রতি তেমন কোন ভাল জন্মায় না। তখন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাঃ
সেই মহিলাকে সব সময় মৃত্যুর কথা স্মরণ করতে বলেন। সেই মহিলা কিছুদিন পর এসে জানালেন
নিজের মৃত্যুর কথা অনবরত চিন্তা বা স্মরণ করার পর
তার জীবনে পরিবর্তন এসেছে। এখন সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার ইবাদতে একাগ্রতা ও ভালবাসা আসছে। পরে সেই মহিলা হযরত আয়েশা রাঃ কে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
শাইখ আব্দুল মতিন সাহেব আরও বলেন,মহান আল্লাহতায়ালার নবী ও রাসূলগণ হিংসা ও বিদ্বেষকে
খুব ভয় করতেন। মানুষের এই খারাপ গুণাবলী গুলি
সমাজ তথা একজন আল্লাহর একজন প্রিয় মুমিন
বান্দা হওয়ার পথে প্রধান অন্তরায়। এই প্রসঙ্গে তিনি
পবিত্র কোরআন বর্ণিত ঘটনা শয়তানের প্ররোচনায় হিংসার বশবর্তী হয়ে হযরত আদম আঃ এর সন্তান কাবিল কর্তৃক ভাই হাবিলকে হত্যার কাহিনীটি বর্ণনা
করেন।
তিনি আরও বলেন,আমাদের মৃত্যুর প্রস্তুতিতে আরও
একটি অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় আমাদের অহংকার।
কাজেই আমাদের দুনিয়াতে শান্তি-শৃঙ্খলা এবং
পরকালে সফলতা লাভ করতে হলে হিংসা, বিদ্বেষ
ও অহংকার পরিত্যাগ করতে হবে। শাইখ জানান,
মহান আল্লাহ কোরআনে মানুষ সম্বোধন করে বার বার বলেছেন আল্লাহকে বেশী পরিমানে সকাল সন্ধ্যায় স্মরণ করতে। তিনি বলেন শুধুমাত্র মসজিদে গিয়ে
নামাজ পড়াই আল্লাহর ইবাদতের শেষ না।
আল্লাহর নবী ও রাসূল মোহাম্মদ সাঃ এবং তাঁর সাথী
বা সাহাবী রাঃ গণের জীবনী দেখলেই জানতে পারবো যে,তাঁরা কিভাবে নিজেদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে
ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একজন আদর্শ মানুষ
হিসাবে দুনিয়ার জীবন শেষ করে আল্লাহর নির্ধারিত
সময়ে মৃত্যুবরণ করে দুনিয়া ছেড়ে না ফেরার দেশে
পাড়ি দিয়েছেন। তাঁরা মহান আল্লাহতায়ালার নিকট
দুনিয়ার জীবনে সফল ও সত্যিকারের মানুষ
হিসাবে স্বীকৃত হওয়ায় প্রায় দেড় হাজার বছর পরেও আজ আমরা তাদের কাজকর্ম অনুসরণ করছি।
শেষ বক্তা হিসাবে মাদানী কোরআন স্কুলে প্রতিষ্ঠাতা
এবং অস্ট্রিয়া বাংলাদেশ কমিউনিটির সিনিয়র ইমাম
ড.ফারুক আল মাদানী তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য বলেন,আমাদের সকলের উচিত আমাদের সন্তানদের
কোরআন ও হাদিসের আলোকে সত্যিকারের মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা। এই প্রসঙ্গে তিনি আল্লাহর নবী
মোহাম্মদ সাঃ হাদিস নেক সন্তান রেখে যাওয়া এবং
আল্লাহর রাস্তায় দান করার সদকায়ে জারিয়ার কথা
উল্লেখ করেন।
তিনি আরও বলেন,নেক্সট সন্তান এমনিতেই হবে না।
আমার ও আপনাদের সন্তানকে নেক সন্তান হিসাবে
গড়ে তুলতে হলে তাকে যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা,সময়
এবং তার সঠিক জ্ঞ্যান অর্জনের জন্য নিজের সাধ্য
অনুযায়ী অর্থ ব্যয় করতে হবে।
আলোচনা শেষে শাইখ ড.ফারুক আল মাদানীর
অনুরোধে দোয়া করেন শাইখ আব্দুল মতিন সাহেব।
তিনি তার দোয়ায় আমাদের সকলকে মৃত্যুর পূর্বেই
মৃত্যুর প্রস্তুতি গ্রহণের সৌভাগ্য দান করার জন্য মহান আল্লাহতায়ালার সাহায্য প্রার্থনা করেন। অস্ট্রিয়া বাংলাদেশ কমিউনিটির যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের সকলের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন।
পরিশেষে এই বিশেষ ইসলামি ইলমী অনুষ্ঠানের শেষ
হলে জামায়াতে এশার নামাজের পর মাদানী কোরআন স্কুলের পক্ষ থেকে আগত অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়। মাদানী কোরআন স্কুলের এই ইসলামী
ইলমী অনুষ্ঠানে অসংখ্য পুরুষ মানুষের সাথে সাথে
অস্ট্রিয়া বাংলাদেশ কমিউনিটির অনেক মহিলারও
উপস্থিত ছিলেন।
বিডিনিউজ ইউরোপ২৪ডটকম/১মার্চ/জই