কলমীরা থেমে গেলে–মাহফুজুল আলম
বহুদিন আগে আমার লেখা গল্প “বকশিস” পড়ে একজন পাঠক বলেছিলেন, “এটা কি আপনার জীবনের ঘটে যাওয়া সত্যিই ঘটনা?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, পুরোটাই সত্যি।”
এভাবে বিভিন্ন সময় আমার বিভিন্ন সময়ের লেখা নিয়ে অনেক জায়গা হতে ম্যাসেজ আসা শুরু হলো। অনেকেই বললেন, আমি এত লেখার সময় পাই কিভাবে? প্রবাসে ব্যস্ত সময় কাটাই, তারপরও এত ছোট ছোট ঘটনা কিভাবে চোখে পড়ে?
একটি কমন উত্তর দেই তাদের, “এড়িয়ে যেতে পারিনা বলেই চোখে পড়ে।”
লেখার জন্য আলাদা কোন সময় নেই আমার। আছে, যেমন – কফি হাউজের লাইনে দাড়িয়ে থাকবার সময়, ব্রেকফাস্ট বা লাঞ্চ টাইমের মধ্যে, অনেক্ষণ ফোনে ওয়েটিংয়ে থাকলে , গাড়ি ড্রাইভ করতে গিয়ে সিগনালের বাতি সবুজ না হওয়া পর্যন্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। অতি জরুরী কাজের ফাঁকেও আমার এমন প্রচুর ও বাছাকৃত টুকরো সময় থাকে। যেগুলো কাজে লাগাতে ইচ্ছে করে। অফিসের ফাঁকে কিভাবে লিখি সেটা বলবো না কারণ আবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে কুপাঠক সততা নিয়ে প্রশ্ন ছুড়বেন। যাইহোক টুকরো সময়গুলিই হচ্ছে আমার বিশেষসময়। এই সময়ে আমার শিংহভাগ লেখা লিখি। আরো ছোট্ট ছোট্ট অজস্র টুকরো টুকরো সময় আমার কাছে থাকে। যেমন বাচ্চাদের নিয়ে পার্কে খেলতে দিয়ে তদারকি করার ফাঁকে, মাছ মারতে দিয়ে দেখে রাখা, বাচ্চাদের বাথরুম করার সময় ওয়েটিংয়ে থাকার সময়, পড়তে বসিয়ে দিয়ে পড়া আদায়ের ফাঁকে ইত্যাদি। কথাগুলো শুনে কেউ বিশ্বাস করেন আবার কেউবা করেন না।
যাকগে, জীবন মানেই প্রচুর গল্প। গত দু’বছরে আনুমানিক একশো এর উপর ছোট গল্প লিখেছি। কবিতা/উপন্যাসও লেখা চলছিল একই ভাবে। আমি ভুল করে না থাকলে কোথাও যেন পড়েছিলাম, “কলম মাঝে মাঝেই তার নিজের প্রয়োজনে থেমে যায়।”
কি জানি, কারো উক্তির মারপ্যাচে সত্যি সত্যিই সেটা সত্যি হলো কিনা!
এখন লিখতে ইচ্ছে হয় না। পুরোনো লেখাগুলো দুই-একবার করে ঝলক দেয়। তাও পুরোটা নয়। গল্পগুলো আর আগের মত আসে না। সম্পর্কগুলো নির্লজ্জভাবে নির্লিপ্ত। আর রোমান্টিক গল্পগুলো ধোঁয়াটে। মাথার উপর থুথু ছিটিয়ে গল্পের প্রধান চরিত্রগুলো ঘেন্না খায়। ননফ্রিকশনগুলো ভোতা মনে হয়। গুছিয়ে তুলতে পারি না। কোথায় যেন আটকে গেছে। গলা খাকড়ানি দিয়ে কাশি সরাতে যেভাবে চেষ্টা করতে হয়, তেমন করে মনের খাকড়ানি দেই। মনের মধ্যে বুদবুদ তোলে। ফেনাগুলো “এয়ার বাবল” হয়ে ফুলে ওঠে। তারপর হঠাৎ ফেটে যায়। ফেটে গিয়ে মিলিয়ে যায়। আবার বুদবুদ তোলে। কিন্তু গল্পগুলো জমে না।
একটা সময় কথায় কথায় গল্প লিখতাম। হাজার হাজার গল্পরা প্যারোডি তুলতো। যেসব আমার চারপাশ ঘিরে গিজগিজ করতো। কোনটা রেখে কোনটা লিখবো। এখনো বেশ কিছু গল্প/উপন্যাস পেনডিং হয়ে পড়ে রয়েছে। কবিতার সংখ্যাও তাই। সবই পড়ে আছে। কলম আটকে আছে কলমে। চোখ ব্যথা পায় ইউটিউব চ্যানেলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। ছুটিরদিন সে ব্যথাটা আরো অনেকগুণ বেশি হয়। তারপর ঘুম হারাম হবার মত হয়ে যায়। প্রচন্ড মাথাব্যথা ও চোখের ব্যথা চলতেই থাকে।
সময় পার হয়ে যায়। কোন লেখাই বের হয়না কলমে। কিংবা কিপ্যাড ছোঁয় না আঙ্গুল। এটাকে বিরস সময় বলে কিনা জানি না; কিংবা বিরতি। করোনার মত মহামারি মারামারি করে মানুষের জীবনে। কলমীদের এটাও একটা গল্প। হয়তো সত্যি। হয়তো এটাই স্বাভাবিকতা।
ঝরঝরে লেখা, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খুটিনাটি, কম্বিনেশন অব ননফ্রিকসন, হোম অব লাভ, তারপর জীবন্ত ঘটনার প্রতিউত্তর, প্রতিউত্তরের প্রতি প্রতিউত্তর। এসব হয় না। এখন অন্য গল্প হয়। মনে মনে আওড়ে যাই তা। প্রকাশ পায় না। যাবর কাটা গল্পগুলো মনে পড়ে। মনে পড়লে কষ্ট হয়। পচে যাওয়া সম্পর্কগুলো নির্লজ্জের মত জেকে বসে আছে। কিছুতেই মাথা হতে নামবে না।
আবার সুন্দর গল্পগুলো এর বিপরীত। প্রচন্ড রোমান্টিক। কিন্তু এখন কলমের ঢগায় রোমান্টিক গল্প কেন, সব গল্পই ফুরুত করে উড়ে গেছে।
অবাক লাগে এসব দেখে। আমি বুঝি না আমাকে। আমি কি সব ভাবছি। কি লিখছি। কি কি লিখতে চাইছি।
এক সময় ভাবতাম এই বুঝি আমার লেখার শুরু হয়েছে। একেবারে পাহাড়ের উঁচু ঢাল হতে সমতলের দিকে আমার গল্পগুলো একটার পর একটা গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে থাকবে। অনেক কিছু লিখবো ভাবতাম। এখন ভাবি না। এখন মনে হয় সমতলে এসে পৌঁছে গেছি বহু আগেই। আর কোন গল্প নেই। পৃথিবীর সবচাইতে চর্চিত শব্দটি আজ প্রশ্নের সম্মুখিন।
একটি কুমড়ো গাছের লতিয়ে বেড়ে ওঠা দেখছি। কয়েকটি ফুল এসেছে তাতে। আজই দেখলাম । সামান্য প্রস্ফুটিত হয়েছে। ক’দিনের মাঝেই পুরোপুরি ফুটবে। নতুন গাছ, নতুন পাতা, নতুন ফুল । তার আগে মাটিতে বিষ বা আবর্জনা দেওয়া হয়েছিল। সেই আবর্জনা হতেই নতুন কুড়ির জন্ম। কি জানি, ননফ্রিকসন লিখতে এটাও একটি গল্পের “মুখ (প্রারম্ভিকা)” কিনা!
আবর্জনা এবং আবর্জনা হতে নতুন কুড়ি। কি সব ছাইপাশ ঘুরছে মাথায়। যদি তাই হয় তবে এই পর্যন্ত লিখেই থেমে যাবো। এরপর কি লিখবো? নাহ্, এখন আর মনে করতে পারছি না।।
লেখকঃমাহফুজুল আলম বৈমানিক ও বহু মাত্রিক লেখক
ফ্লোরিডা থেকে
বিডিনিউজ ইউরোপ২৪ডটকম/২৪ জানুয়ারি/জই