দৈনিক সমকাল থেকে সংগ্রহঃ
পিপিপি অর্থাৎ প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপের ধারণা প্রবর্তন করে সবাইকে চমক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বর্তমান সরকারের ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে এ ঘোষণা করেন তিনি। এর পর দশ বছর পার হলেও পিপিপি গতি পায়নি। এমনকি ১৭ নভেম্বরে সমকালের খবরে আমরা দেখেছি, পিপিপির অর্ধেক প্রকল্প বাদ পড়ছে। পিপিপি কর্তৃপক্ষের নির্বাহী বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পিপিপির আওতায় পাইপলাইনে থাকা ৭৭টি প্রকল্পকে নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনকগুলো রেখে বাকি প্রকল্প বাদ দিতে হবে। যেসব প্রকল্প পিপিপির আওতায় রাখার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোরও ভবিষ্যৎ কতটা রয়েছে, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
পিপিপি অন্যান্য দেশে অত্যন্ত সফলভাবে বাস্তবায়ন হলেও আমাদের দেশে কেন এই অবস্থা? উন্নয়ন অর্থায়নের নতুন জানালা হিসেবে আবির্ভূত হওয়া সত্ত্বেও পিপিপি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ একটিই- এটি চমক হিসেবে এলেও সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। যার ফলে আমরা দেখছি, প্রকল্প নেওয়া হলেও তার সম্ভাব্যতা যাচাই হয়নি। কয়েকটি প্রকল্পে রয়েছে ভূমি-সংক্রান্ত জটিলতা। আবার কয়েকটি প্রকল্পে সম্ভাব্যতা যাচাই এখনও শেষ হয়নি। দশ বছর পরও যদি এখনও পিপিপির প্রকল্পগুলোর অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনাই চলে এবং যাচাই-বাছাই শেষ না হয় তবে বাস্তবায়ন হবে কবে? প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কথা এখন কেন আসছে? এটা তো প্রকল্প গ্রহণের আগের কাজ।
পিপিপি মানে সরকারি-বেসরকারি যৌথ অংশীদারিত্বে প্রকল্প গ্রহণ, অর্থায়ন ও বাস্তবায়ন। এটি সফল করতে হলে প্রথমেই দেখতে হবে প্রকল্প নির্বাচন কতটা সঠিক। তারপর দেখার বিষয় উভয়ের মধ্যে কতটা আস্থা রয়েছে। পাশাপাশি প্রকল্প কতটা লাভজনক এবং উন্নয়ন সহায়ক কিনা তা জরুরি। প্রকল্পের বাণিজ্যিক দিকের পাশাপাশি পদ্ধতিগত জটিলতা নিরসন, পিপিপি কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমে লক্ষ্য নির্ধারণও প্রয়োজন। এসব সম্পাদনের ক্ষেত্রে দেখা যাবে সরকার কতটা আন্তরিক। তথা পিপিপি বাস্তবায়নে সরকার কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু আমরা যেটা দেখছি, সমস্যা আমলাতান্ত্রিক মানসিকতায়। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই আমলাতন্ত্র রয়েছে। আমলাতন্ত্র কিংবা প্রশাসনযন্ত্র দিয়ে অনেক দেশই ভালো করছে। আমলাতন্ত্র আর আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা এক বিষয় নয়। আমাদের এখানে আমলাতান্ত্রিক মানসিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এককেন্দ্রিক রাজনৈতিক দর্শন। এ দর্শনে অংশগ্রহণকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। এখানে জবাবদিহি অনুপস্থিত। আমলাতান্ত্রিক এ মানসিকতার কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব দেখছি। এটা সবখানেই দৃশ্যমান। আমাদের এডিপি ঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয় না কেন- কারণটা এখানেই।
পিপিপি চালুর পর থেকে এখন পর্যন্ত সর্বসাকুল্যে দুই-তিনটি প্রকল্প দৃশ্যমান। সমকালের প্রতিবেদনে ৭৭টি প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে। আর কোনো প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। পিপিপির বেশিরভাগ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে অবকাঠামো খাতের। দেখা যাচ্ছে, পিপিপি কেবল হোঁচটই খায়নি বরং এটি এখনও আঁতুড়ঘর থেকেই বের হতে পারেনি। পিপিপি চালুর পর থেকে বাজেটের পর বাজেট আসে। বাজেটে আলাদা থোক বরাদ্দ রাখা হলেও পিপিপির অর্থ খরচ হয় না। প্রয়োজন না থাকায় টাকাও ছাড় করা হয় না। আসলে পিপিপিকে গতিশীল করতে যে গুরুত্ব দেওয়া উচিত সরকার তা দেয়নি। এখানে সমস্যাটা কেবল পিপিপি কিংবা নির্দিষ্ট কোনো প্রকল্পের নয়; সমস্যা ইকোনমিক গভর্ন্যান্সের। এ জন্য সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। যদি কেবল চমক দেখানোর জন্য প্রকল্প হয়, তা বাস্তবায়ন কঠিন। যথাযথ গুরুত্ব পেলেই তখন আমরা দেখব জনবলসহ ছোটখাটো সমস্যা সামনে আসবে না। এসব সমস্যা থাকছে মানে হলো অফিসটি যথাযথভাবে ক্ষমতায়িত হয়নি।
আমরা দেখছি লাভজনক প্রকল্পগুলো সরকার নিজে বাস্তবায়ন করছে। অথচ যেগুলো অর্থনৈতিক দিক থেকে আকর্ষণীয় নয়, সেগুলো পিপিপিতে দিচ্ছে। সেখানে বেসরকারি খাত কেন আগ্রহী হবে? বেসরকারি খাতকে আগ্রহী করতে হলে লাভের বিষয়টি যেমন দেখতে হবে, তেমনি পদ্ধতিগত সংস্কারও জরুরি। বিশ্বের অনেক দেশে সড়ক হচ্ছে পিপিপির আওতায়। ওই সড়কের কারণে যেসব নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে, সেখান থেকে আসা করের অংশ পাচ্ছে পিপিপির বেসরকারি অংশীদার। অন্য দেশ এসব করতে পারছে; কারণ তারা একদিকে আস্থার জায়গা তৈরি করেছে, অন্যদিকে বিষয়টিকে দক্ষতা ও গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। সেখানে প্রাইভেট মানে প্রতিযোগিতা। অর্থাৎ আপনি সরকারের সঙ্গে কাজ করবেন, প্রকল্পে বিনিয়োগ করবেন। অংশীদারিত্বের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতাও সরকার যাচাই করবে। সেখানে কাজ পেতে স্বজনপ্রীতি নেই। যোগ্যরাই কাজ করতে পারছে। তার ওপর দুর্নীতিমুক্ত হয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে।
পিপিপি জরুরি এজন্য, যাতে বেসরকারি খাত উন্নয়নে এগিয়ে আসে। পিপিপি এমন ব্যবস্থা যেখানে জনগণকে সেবা দিতে বেসরকারি খাত বিনিয়োগ করে থাকে। এতে সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের চুক্তি হয়। আমাদের জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে হাসপাতাল, বন্দর, সড়ক দরকার। প্রয়োজন সেতু নির্মাণ। সরকারের একার পক্ষে এগুলো করা কঠিন। প্রতিবছর ৩৯ হাজার কোটি হিসাবে পাঁচ বছরে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা পিপিপি উদ্যোগ থেকে পাওয়া যাবে বলে ২০০৯ সালেই শুনিয়েছিলেন সে সময়ের অর্থমন্ত্রী। বাণিজ্যিকভাবে আপাতত অলাভজনক কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনসেবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পিপিপি প্রকল্পগুলোকে সহায়তার জন্যও বরাদ্দ রাখছে সরকার। সুযোগ রাখা হয়েছে প্রকল্পের কারিগরি সহায়তা বাবদ ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফাইন্যান্সিং (ভিজিএফ) থেকেও অর্থ ব্যয়ের। তাও গতিহীন পিপিপি।
পিপিপিতে কেবল বড় প্রকল্প দিলেই হবে না। পাশাপাশি ছোট ও মাঝারি প্রকল্প নিলে অনেক প্রতিষ্ঠানই আগ্রহী হতে পারে। এমনকি আমাদের প্রবাসীরাও বিনিয়োগ করতে পারে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতেও পিপিপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পানি, বিমানবন্দর, মহাসড়ক, মেট্রোরেল, শিক্ষা, হাসপাতাল, আবাসন খাত এমনকি পোশাক খাতেও পিপিপির মাধ্যমে প্রকল্প নেওয়া সম্ভব। যে দেশগুলো পিপিপিতে সফল হয়েছে, তারা যুগোপযোগী পিপিপি মডেল গ্রহণের মাধ্যমে তা করেছে। সেইসঙ্গে লাভজনক হওয়া, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিষয়ও রয়েছে।
পিপিপিকে আঁতুড়ঘর থেকে বের করতে হলে অন্যান্য দেশের মতো আমাদের সরকারকেও একই পথে হাঁটতে হবে। উন্নয়ন সহায়ক ও লাভজনক প্রকল্প হাতে নিয়ে পিপিপির জন্য প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান নিতে হবে। চমক হিসেবে আসা পিপিপি যদি সফল না হয় সেটি হবে দুঃখজনক। সরকারের আন্তরিক সদিচ্ছা ও অগ্রাধিকারই পিপিপিকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিতে সক্ষম।
লিখেছেনঃ
চেয়ারপারসন, ব্র্যাক ও এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান, পিপিআরসি, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
বিডিনিউজ ইউরোপ/২৮ নভেম্বর / জই